ধর্ম্মতত্ত্ব
তা ছাড়া, আমাদের কতকগুলি মানসিক শক্তি আছে। সেগুলির অনুশীলনের যে ফল, তাহাও সুখ। ইহাই সুখ, ইহা ভিন্ন অন্য কোন সুখ নাই। ইহার অভাব দুঃখ। বুঝিলে?
শিষ্য। না। প্রথমতঃ শক্তি কথাটাতেই গোল পড়িতেছে। মনে করুন, দয়া আমাদিগের মনের একটি অবস্থা। তাহার অনুশীলনে সুখ আছে। কিন্তু আমি কি বলিব যে দয়া শক্তির অনুশীলন করিতে হইবে?
গুরু। শক্তি কথাটা গোলের বটে। তৎপরিবর্ত্তে অন্য শব্দের আদেশ করার প্রতি আমার কোন আপত্তি নাই। আগে জিনিসটা বুঝ, তার পর যাহা বলিবে, তাহাতেই বুঝা যাইবে। শরীর এক ও মন এক বটে, তথাপি ইহাদিগের বিশেষ বিশেষ ক্রিয়া আছে; এবং কাজেই সেই সকল বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সম্পাদনকারী বিশেষ বিশেষ শক্তি কল্পনা করা অবৈজ্ঞানিক হয় না। কেন না, আদৌ এই সকল শক্তির মূল এক হইলেও, কার্য্যতঃ ইহাদিগের পার্থক্য দেখিতে পাই। যে অন্ধ, সে দেখিতে পায় না, কিন্তু শব্দ শুনিতে পায়; যে বধির, সে শব্দ শুনিতে পায় না, কিন্তু চক্ষে দেখিতে পায়। কেহ কিছু স্মরণ রাখিতে পারে না, কিন্তু সে হয়ত সুকল্পনাবিশিষ্ট কবি; আবার কেহ কল্পনায় অক্ষম, কিন্তু বড় মেধাবী। কেহ ঈশ্বরে ভক্তিশূন্য, কিন্তু লোককে দয়া করে; আবার নির্দ্দয় লোককেও ঈশ্বরে কিঞ্চিৎ ভক্তিবিশিষ্ট দেখা গিয়াছে।* সুতরাং দেহ ও মনের ভিন্ন ভিন্ন শক্তি স্বীকার করা যাইতে পারে। তবে কতকগুলি শক্তি-যথা স্নেহ, দয়া ইত্যাদিকে শক্তি বলা ভাল শুনায় না। কিন্তু অন্য ব্যবহার্য্য শব্দ কি আছে?
শিষ্য। ইংরাজি শব্দটা faculty, অনেক বাঙ্গালি লেখক বৃত্তি শব্দের দ্বারা তাহার অনুবাদ করিয়াছেন।
গুরু। পাতঞ্জল প্রভৃতি দর্শনশাস্ত্রে বৃত্তি শব্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে।
শিষ্য। কিন্তু এক্ষণে সে অর্থ বাঙ্গালা ভাষায় অপ্রচলিত। বৃত্তি শব্দ চলিয়াছে।
গুরু। তবে বৃত্তিই চালাও। বুঝিলেই হইল। যখন তোমরা morals অর্থে “নীতি” শব্দ চালাইয়াছ, Science অর্থে “বিজ্ঞান” চালাইয়াছ, তখন faculty অর্থে “বৃত্তি” শব্দ চালাইলে দোষ ধরিব না।
শিষ্য। তার পর আমার দ্বিতীয় আপত্তি। আপনি বলিলেন, বৃত্তির অনুশীলন সুখ-কিন্তু জল বিনা তৃষ্ণার অনুশীলনে দুঃখ।
গুরু। রও। বৃত্তির অনুশীলনের ফল ক্রমশঃ স্ফূর্ত্তি, চরমে পরিণতাবস্থা, তার পর উদ্দিষ্ট বস্তুর সম্মিলনে পরিতৃপ্তি। এই স্ফূর্ত্তি এবং পরিতৃপ্তি উভয়ই সুখের পক্ষে আবশ্যক।
শিষ্য। ইহা যদি সুখ হয়, তবে বোধ হয়, এরূপ সুখ মনুষ্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নহে।
গুরু। কেন?
শিষ্য। ইন্দ্রিয়পর ব্যক্তির ইন্দ্রিয়বৃত্তির অনুশীলনে পরিতৃপ্তিতে সুখ। তাই কি তাহার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত?
গুরু। না। তাহা নহে। তাহা হইলেই ইন্দ্রিয় প্রবলতাহেতু মানসিক বৃত্তি সকলের অস্ফূর্ত্তি এবং ক্রমশঃ বিলোপ হইবার সম্ভাবনা। এ বিষয়ে স্থূল নিয়ম হইতেছে সামঞ্জস্যই। ইন্দ্রিয় সকলেরও এককালীন বিলোপ ধর্ম্মানুমত নহে। তাহাদের সামঞ্জস্যই ধর্ম্মানুমত। বিলোপে ও সংযমে অনেক প্রভেদ। সে কথা পশ্চাৎ বুঝাইব। এখন স্থূল কথাটা বুঝিয়া রাখ যে, বৃত্তি সকলের অনুশীলনের স্থূল নিয়ম পরস্পরের সহিত সামঞ্জস্য। এই সামঞ্জস্য কি, তাহা সবিস্তারে একদিন বুঝাইব। এখন কথাটা এই বুঝাইতেছি যে, সুখের উপাদান কি?
* উদাহরণ-বিলাতের সপ্তদশ শতাব্দীর Puritan সম্প্রদায়। অপিচ, Inquisition অধ্যক্ষেরা।