কৃষ্ণচরিত্র - ষষ্ঠ খণ্ড
কৃষ্ণের দেহত্যাগের কারণটা কতক অনিশ্চিত রহিল। চারি প্রকার কারণ নির্দেশ করা যাইতে পারে।
প্রথম, টাল্বয়স-হুইলরি সম্প্রদায় বলিতে পারেন, কৃষ্ণ, জুলিয়স্ কাইসরের মত, দ্বেষবিশিষ্ট বন্ধুগণ কর্তৃক নিহত হইয়াছিলেন। এরূপ কথা কোন গ্রন্থেই নাই।
দ্বিতীয়, তিনি যোগাবলম্বন করিয়া দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। পাশ্চাত্য-বৈজ্ঞানিকদিগের শিষ্যগণ যোগাবল্বনে দেহত্যাগের কথাটার বিশ্বাস করিবেন না। আমি নিজে অবিশ্বাসের কারণ দেখি না। যাঁহারা যোগাভ্যাসকালে নিশ্বাস অবরুদ্ধ করা অভ্যাস করিয়াছেন, তাঁহারা নিশ্বাস অবরুদ্ধ করিয়া আপনার মৃত্যু সম্পাদন করিতে পারেন না, এমন কথা আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি না। এরূপ ঘটনা বিশ্বস্তসূত্রে শুনাও গিয়া থাকে। অন্যে বলিতে পারেন, ইহা আত্মহত্যা, সুতরাং পাপ; সুতরাং আদর্শ মনুষ্যের অনাচরণীয়, আমি ঠিক তাহা বলিতে পারি না। প্রাচীন বয়সে, জীবনের কার্য সমস্ত সম্পন্ন হইলে পরে, ঈশ্বরে লীন হইবার জন্য, মনোমধ্যে তন্ময় হইয়া, শ্বাসরোধকে আত্মহত্যা বলিব না, “ঈশ্বরপ্রাপ্তি” বলিব? সেটা বিচারস্থল। আত্মহত্যা মহাপাপ স্বীকার করি, জীবনশেষে যোগবলে প্রাণত্যাগও কি তাই?
তৃতীয়, জরাব্যাধের শরাঘাত।
চতুর্থ, এই সময়ে কৃষ্ণের বয়স শত বর্ষের অধিক হইয়াছিল, বলিয়া বিষ্ণুপুরাণে কথিত হইয়াছিল। এই জরাব্যাধ, জরাব্যাধি নয় ত?
যাঁহারা কৃষ্ণকে মনুষ্যমাত্র বিবেচনা করিয়া তাঁহার ঈশ্বরত্ব স্বীকার করেন না, তাঁহারা এই চারিটি মতের যে কোনটি গ্রহণ করিতে পারেন। আমি কৃষ্ণকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করি। অতএব আমি বলি, কৃষ্ণের ইচ্ছাই কৃষ্ণের দেহত্যাগের কারণ। আমার মতে ইহা বটে যে, জগতে মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচার তাঁহার ইচ্ছা এবং সেই ইচ্ছা পূরণজন্য তিনি মানুষী শক্তির দ্বারা সকল কর্ম নির্বাহ করেন, কিন্তু তাহা বলিলেও ঈশ্বরাবতারের জন্মমৃত্যু তাঁহার ইচ্ছাধীন মাত্র বলিতে হইবে। অতএব আমি বলি, কৃষ্ণের ইচ্ছাই কৃষ্ণের দেহত্যাগের একমাত্র কারণ।
মৌসলপর্ব মহাভারতের প্রথম স্তরের অন্তর্গত কি না, তাহার আমি বিচার করি নাই। বিশেষ প্রয়োজন নাই, বলিয়া সমালোচনা করি নাই। বিশেষ প্রয়োজন নাই কেন, তাহাও বলিয়াছি। স্থূল ঘটনাটা কতক সত্য বলিয়াই বোধ হয়। তবে তাহা হইলেও, ইহা মহাভারতের প্রথম স্তরের অন্তর্গত নহে বলিয়াই বোধ হয়। যাহা পুরাণ ও হরিবংশে আছে, কৃষ্ণজীবনঘটিত এমন আর কোন ঘটনাই মহাভারতে নাই। একটিই কেবল পুরাণাদিতেও আছে, হরিবংশেও আছে, মহাভারতেও আছে। পাণ্ডবদিগের সম্বন্ধে যাহা কিছু কৃষ্ণ করিয়াছিলেন, তাহা ভিন্ন আর কোন কৃষ্ণবৃত্তান্ত মহাভারতে নাই ও থাকিবার সম্ভাবনা নাই। এইটিই কেবল সে নিয়মবহির্ভূত। কৃষ্ণ এখানে ঈশ্বরাবতার, এটি দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের চিহ্ন পূর্বে বলিয়াছি। এরূপ বিবেচনা করিবার অন্যান্য হেতুও নির্দেশ করা যাইতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনাভাব। তবে, ইহা বলা কর্তব্য যে, অনুক্রমণিকাধ্যায়ে মৌসলপর্বের কোন প্রসঙ্গই নাই। পরীক্ষিতের জন্মবৃত্তান্তের পরবর্তী কোন কথাই অনুক্রমণিকাধ্যায়ে নাই। আমার বিবেচনায় পরীক্ষিতের জন্মই আদিম মহাভারতের শেষ। তার পরবর্তী যে সকল কথা, তাহা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের।