কৃষ্ণের কৃপায় সেইরূপই হইল। কিন্তু তথাপি ভীষ্ম আপত্তি করিলেন। কৃষ্ণকে বলিলেন, “তুমি স্বয়ং কেন যুধিষ্ঠিরকে হিতোপদেশ প্রদান করিলে না?”

উত্তরে কৃষ্ণ বলিলেন, সমস্ত হিতাহিত কর্ম আমা হইতে সম্ভূত। চন্দ্রের শীতাংশু ঘোষণাও যেরূপ, আমার যশোলাভ সেইরূপ। আমার এখন ইচ্ছা, আপনাকে সমধিক যশস্বী করি। আমার সমুদায় বুদ্ধি সেই জন্য আপনাকে অর্পণ করিয়াছি। ইত্যাদি।

তখন ভীষ্ম প্রফুল্লচিত্তে যুধিষ্ঠিরকে ধর্মতত্ত্ব শুনাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। রাজধর্ম, আপদ্ধর্ম এবং মোক্ষধর্ম অতি সবিস্তারে শুনাইলেন। মোক্ষধর্মের পর শান্তিপর্ব সমাপ্ত।

এই শান্তিপর্বে তিন স্তরই দেখা যায়। প্রথম স্তরই ইহার কঙ্কাল ও তার পর যিনি যেমন ধর্ম বুঝিয়াছেন, তিনিই তাহা শান্তিপর্বভুক্ত করিয়াছেন। ইহার মধ্যে আমাদের সমালোচনার যোগ্য একটা গুরুতর কথা আছে। কেবল ধার্মিককে রাজা করিলেই ধর্মরাজ্য সংস্থাপিত হইল না। আজ ধার্মিক যুধিষ্ঠির রাজা ধর্মাত্মা; কাল তাঁহার উত্তরাধিকারী পাপাত্মা হইতে পারেন। এইজন্য ধর্মরাজ্য সংস্থাপন করিয়া, তাহার রক্ষার জন্য ধর্মানুমত ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করাও চাই। রণজয়, রাজ্য স্থাপনের প্রথম কার্য মাত্র; তাহার শাসন জন্য বিধিব্যবস্থাই (Legislation) প্রধান কার্য। কৃষ্ণ সেই কার্যে ভীষ্মকে নিযুক্ত করিলেন। ভীষ্মকে নিযুক্ত করিলেন, তাহার বিশেষ কারণ ছিল; আদর্শ নীতিজ্ঞই তাহা লক্ষিত করিতে পারেন। কৃষ্ণ সেই সকল কারণ নিজেই ভীষ্মকে বুঝাইতেছেন।

“আপনি বয়োবৃদ্ধ এবং শাস্ত্রজ্ঞান এবং শুদ্ধাচারসম্পন্ন। রাজধর্ম ও অপরাপর ধর্ম কিছুই আপনার অবিদিত নাই। জন্মাবধি আপনার কোনও দোষই লক্ষিত হয় নাই, নরপতিগণ আপনারে সর্বধর্মবেত্তা বলিয়া কীর্তন করিয়া থাকেন। অতএব পিতার ন্যায় আপনি এই ভূপালগণকে নীতি উপদেশ প্রদান করুন। আপনি প্রতিনিয়ত ঋষি ও দেবগণের উপাসনা করিয়াছেন। এক্ষণে এই ভূপতিগণ আপনার নিকট ধর্মবৃত্তান্ত শ্রবণোৎসুক হইয়াছেন। অতএব আপনাকে অবশ্যই বিশেষরূপে সমস্ত ধর্মকীর্তন করিতে হইবে। পণ্ডিতদিগের মতে ধর্মোপদেশ প্রদান করা বিদ্বান ব্যক্তিরই কর্তব্য।”

তার পর অনুশাসন পর্ব। এখানেও হিতোপদেশ; যুধিষ্ঠির শ্রোতা, ভীষ্ম বক্তা। কতকগুলা বাজে কথা লইয়া, এই অনুশাসন পর্ব গ্রথিত হইয়াছে। সমুদয়ই বোধ হয় তৃতীয় স্তরের। তন্মধ্যে আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয় কিছু নাই।

পরিশেষে ভীষ্ম স্বর্গারোহণ করিলেন। ইহাই কেবল প্রথম স্তরের।