শৈবলিনীর নৌকার দশা ঠিক এইরূপে ঘটিল। অল্প বেলা হইলেই বায়ু প্রবল হইল। বড় নৌকা, প্রতিকূল বায়ুতে আর চলিল না। রক্ষকেরা ভদ্রহাটির ঘাটে নৌকা রাখিল।

ক্ষণকাল পরে নৌকার কাছে, এক নাপিতানী আসিল। নাপিতানী সধবা, খাটো রাঙ্গাপেড়ে সাড়ীপরা—সাড়ীর রাঙ্গা দেওয়া আঁচলা আছে—হাতে আলতার চুপড়ী। নাপিতানী নৌকার উপর অনেক কালো কালো দাড়ী দেখিয়া ঘোম‍‍টা টানিয়া দিয়াছিল। দাড়ীর অধিকারিগণ অবাক হইয়া নাপিতানীকে দেখিতেছিল।

একটা চরে শৈবলিনীর পাক হইতেছিল—এখনও হিন্দুয়ানি আছে—একজন ব্রাহ্মণ পাক করিতেছিল। একদিনে কিছু বিবি সাজা যায় না। ফষ্টর জানিতেন যে, শৈবলিনী যদি না পলায়, অথবা প্রাণত্যাগ না করে, তবে সে অবশ্য একদিন টেবিলে বসিয়া যবনের কৃত পাক, উপাদেয় বলিয়া ভোজন করিবে। কিন্তু এখনই তাড়াতাড়ি কি? এখন তাড়াতাড়ি করিলে সকল দিক নষ্ট হইবে। এই ভাবিয়া ফষ্টর ভৃত্যদিগের পরামর্শমতে শৈবলিনীর সঙ্গে ব্রাহ্মণ দিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ পাক করিতেছিল, নিকটে একজন দাসী দাঁড়াইয়া উদ্যোগ করিয়া দিতেছিল। নাপিতানী সেই দাসীর কাছে গেল, বলিল, “হাঁ গা—তোমরা কোথা থেকে আসচ গা?”

চাকরাণী রাগ করিল—বিশেষ সে ইংরেজের বেতন খায়—বলিল, “তোর তা কি রে মাগী! আমরা হিল্লী, দিল্লী, মক্কা থেকে আসচি ।”

নাপিতানী অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “বলি তা নয়, আমরা নাপিত—তোমাদের নৌকায় যদি মেয়েছেলে কেহ কামায় তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি ।”

চাকরাণী একটু নরম হইল। বলিল, “আচ্ছা জিজ্ঞাসা করিয়া আসি ।” এই বলিয়া সে শৈবলিনীকে জিজ্ঞাসা করিতে গেল যে, তিনি আল‍তা পরিবেন কিনা। যে কারণেই হউক, শৈবলিনী অন্যমনা হইবার উপায় চিন্তা করিতেছিলেন, বলিলেন, “আল‍তা পরিব ।” তখন রক্ষকদিগের অনুমতি লইয়া, দাসী নাপিতানীকে নৌকার ভিতর পাঠাইয়া দিল। সে স্বয়ং পূর্বমত পাকশালার নিকট নিযুক্ত রহিল।

নাপিতানী শৈবলিনীকে দেখিয়া আর একটু ঘোম‍টা টানিয়া দিল। এবং তাঁহার একটি চরণ লইয়া আল‍তা পরাইতে লাগিল। শৈবলিনী কিয়ৎকাল নাপিতানীকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। দেখিয়া দেখিয়া বলিলেন, “নাপিতানী, তোমার বাড়ী কোথা?”

নাপিতানী কথা কহিল না। শৈবলিনী আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “নাপিতানী, তোমার নাম কি?”

তথাপি উত্তর পাইলেন না।

“নাপিতানী, তুমি কাঁদচ?”

নাপিতানী মৃদু স্বরে বলিল, “না ।”

“হাঁ কাঁদচ ।” বলিয়া শৈবলিনী নাপিতানীর অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া দিলেন। নাপিতানী বাস্তবিক কাঁদিতেছিল। অবগুণ্ঠন মুক্ত হইলে নাপিতানী একটু হাসিল।

শৈবলিনী বলিলেন, “আমি আসতে মাত্র চিনেছি। আমরে কাছে ঘোমটা। মরণ আর কি? তা এখানে এলি কোথা হতে?”

নাপিতানী আর কেহ নহে—সুন্দরী ঠাকুরঝি। সুন্দরী চক্ষের জল মুছিয়া কহিল, “শীঘ্র যাও! আমার এই সাড়ী পর, ছাড়িয়া দিতেছি। এই আলতারর চুপড়ী নাও। ঘোম‍টা দিয়া নৌকা হইতে চলিয়া যাও ।”