কৃষ্ণচরিত্র - ষষ্ঠ খণ্ড
পরে কর্ণার্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হইল। তাহার বর্ণনায় আমার প্রয়োজন নাই। কথিত হইয়াছে যে, কর্ণের সর্পবাণ হইতে কৃষ্ণ অর্জুনকে রক্ষা করিয়াছিলেন। অর্জুন উহার নিবারণ করিতে পারেন নাই, অতএব কৃষ্ণ পদাঘাতে অর্জুনের রথ ভূমিতে কিঞ্চিৎ বসাইয়া দিলেন, অশ্বগণ জানু পাতিয়া পড়িয়া গেল। অর্জুনের মস্তক বাঁচিয়া গেল; কেবল কিরীট কাটা পড়িল। অর্জুন নিজে মস্তক অবনত করিলেও সেই ফল হইত। কথাটা সমালোচনার যোগ্য নহে। তবে কৃষ্ণের সারথ্যের প্রশংসা মহাভারতে পুনঃ পুনঃ দেখা যায়।
যুদ্ধের শেষ ভাগে কর্ণের রথচক্র মাটিতে বসিয়া গেল। কর্ণ তাহা তুলিবার জন্য মাটিতে নামিলেন। যতক্ষণ রথচক্রের উদ্ধার না করেন, ততক্ষণ জন্য অর্জুনের কাছে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। অর্জুনও ক্ষমা করিয়াছিলেন দেখা যাইতেছে, কেন না, কর্ণ তাহার পর আবার রথে উঠিয়া পূর্ববৎ যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু কর্ণের দুর্ভাগ্য যে, ক্ষমা প্রার্থনাকালে তিনি অর্জুনকে এমন কথা বলিয়াছিলেন যে, ধর্মতঃ তিনি ঐ সময়ের জন্য কর্ণকে ক্ষমা করিতে বাধ্য; কৃষ্ণ অধর্মের শাস্তা। তিনি কর্ণকে তখন বলিলেন,
“হে সূতপুত্র! তুমি ভাগ্যক্রমে এক্ষণে ধর্ম স্মরণ করিতেছ। নীচাশয়েরা দুঃখে নিমগ্ন হইয়া প্রায়ই দৈবকে নিন্দা করিয়া থাকে; আপনাদিগকে দুষ্কর্মের প্রতি কিছুতেই দৃষ্টিপাত করে না। দেখ, দুর্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনি তোমার মতানুসারে একবস্ত্রা দ্রৌপদীরে যে সভায় আনয়ন করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন দুষ্ট শকুনি দুরভিসন্ধি-পরতন্ত্র হইয়া তোমার অনুমোদনে অক্ষক্রীড়ায় নিতান্ত অনভিজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন রাজা দুর্যোধন তোমার মতানুযায়ী হইয়া ভীমসেনকে বিষান্ন ভোজন করাইয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি বারণাবত নগরে জতুগৃহমধ্যে প্রসুপ্ত পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিবার নিমিত্ত অগ্নিপ্রদান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি সভামধ্যে দুঃশাসনের বশীভূতা রজস্বলা দ্রৌপদীরে, হে কৃষ্ণে! পাণ্ডবগণ বিনষ্ট হইয়া শাশ্বত নরকে গমন করিয়াছে, এক্ষণে তুমি অন্য পতিরে বরণ কর, এই কথা বলিয়া উপহাস করিয়াছিলে এবং অনার্য ব্যক্তিরা তাঁহারে নিরপরাধে ক্লেশ প্রদান করিলে উপেক্ষা করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি রাজ্যলোভে শকুনিকে আশ্রয়পূর্বক পাণ্ডবগণকে দ্যূতক্রীড়া করিবার নিমিত্ত আহ্বান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি মহারথগণসমবেত হইয়া বালক অভিমন্যুরে পরিবেষ্টন পূর্বক বিনাশ করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল? হে কর্ণ! তুমি যখন তত্তৎকালে অধর্মানুষ্ঠান করিয়াছ, তখন আর সময় ধর্ম ধর্ম করিয়া তালুদেশ শুষ্ক করিলে কি হইবে? তুমি যে এখন ধর্মপরায়ণ হইলেও জীবন সত্ত্বে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইবে, ইহা কদাচ মনে করিও না। পূর্বে নিষধদেশাধিপতি নল যেমন পুষ্কর দ্বারা দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হইয়া পুনরায় রাজ্য লাভ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ধর্মপরায়ণ পাণ্ডবগণও ভুজবলে সোমদিগের সহিত শত্রুগণকে বিনাশ করতঃ রাজ্যলাভ করিবেন। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ ভুজবলে অবশ্যই ধর্মসংরক্ষিত পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হইবে।”
কৃষ্ণের কথা শুনিয়া কর্ণ লজ্জায় মস্তক অবনত করিলেন। তার পর পূর্বমত যুদ্ধ করিয়া, অর্জুনবাণে নিহত হইলেন।