কৃষ্ণচরিত্র - ষষ্ঠ খণ্ড
অতএব উপন্যাসটি প্রথমতঃ প্রক্ষিপ্ত, দ্বিতীয়তঃ মিথ্যা। আমি এমত বলি না যে, ঋষিবাক্যে দ্রোণের অস্ত্র পরিত্যাগ করাই সত্য। ঋষিদের সেই রণক্ষেত্রে আগমন অনৈসর্গিক ব্যাপার, সুতরাং তাহাও অপ্রকৃত বলিয়া পরিত্যাগ করিতে আমি বাধ্য। ইহার মধ্যে প্রকৃত বা বিশ্বাসযোগ্য কথা এই হইতে পারে যে, দ্রোণ অধর্মাচরণ করিতেছিলেন—ভীমের তীব্র তিরস্কারে তাহা তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হইয়াছিল। যুদ্ধে বিমুখ হওয়া তাঁহার সাধ্য নহে—অপটুতা এবং দুর্যোধনকে বিপৎকালে পরিত্যাগ, এই উভয় দোষেই দূষিত হইতে হইবে। অতএব মৃত্যুই স্থির করিলেন। বোধ হয়, এতটুকু একটু কিংবদন্তী ছিল—তাহারই উপর মহাভারতের উপর স্তর নির্মিত হইয়াছিল। হয়ত, তাহাও যথার্থ ঘটনা নহে। বোধ হয়, যথার্থ ঘটনা এই পর্যন্ত যে, দ্রোণ যুদ্ধে দ্রুপদপুত্র কর্তৃক নিহত হইয়াছিলেন; পরে যাহা বলিতেছি, তাহাতে তাই বুঝায়; তার পর প্রবলপ্রতাপ পাঞ্চালবংশকে ব্রহ্মহত্যাকলঙ্ক হইতে উদ্ধৃত করিবার জন্য নানাবিধ উপন্যাস প্রস্তুত হইয়াছে।
(৪) এখন দেখা যাউক অনুক্রমণিকাধ্যায়ে, এবং পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে কি আছে। অনুক্রমণিকাধ্যায়ে ধৃতরাষ্ট্রবিলাপে এই মাত্র আছে যে—
“যদাশ্রৌষং দ্রোণমাচার্যমেকং ধৃষ্টদ্যুম্নেনাভ্যতিক্রম্য ধর্মম্।
রথোপস্থে প্রায়গতং বিশস্তং তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয় ||”
অর্থ। হে সঞ্জয়! যখন শুনিলাম যে, এক আচার্য দ্রোণকে ধৃষ্টদ্যুম্ন ধর্মাতিক্রমপূর্বক প্রায়োপবিষ্ট অবস্থায় রথোপস্থে বধ করিয়াছে, তখন আর জয়ে সন্দেহ করি নাই।
অতএব এখানেও দেখা যাইতেছে যে, দ্রোণবধে ধৃষ্টদ্যুম্ন ভিন্ন আর কেহ অধর্মাচরণ করে নাই। ধৃষ্টদ্যুম্নেরও পাপ এই যে, প্রায়োপবিষ্ট বৃদ্ধকে তিনি নিহত করিয়াছিলেন। দ্রোণের প্রায়োপবেশনের কারণ এখানে কিছু কথিত হয় নাই। যুধিষ্ঠিরবাক্যে বা ঋষিগণের বাক্যে বা ভীমের তিরস্কারে, তাহা কিছু কথিত হয় নাই। পশ্চাৎ দেখিব, তিনি পরে শ্রান্ত হইয়াই, নিহত হয়েন। আসন্নমৃত্যু ব্রাহ্মণের প্রায়োপবেশনের সেও উপযুক্ত কারণ।
(৫) পর্বসংগ্রহাধ্যায়ে কোন কথাই নাই—“দ্রোণে যুধি নিপাতিতে,” এ ছাড়া আর কিছুই নাই। হত গজের কথাটা সত্য হইলে, তাহার প্রসঙ্গ অবশ্যই থাকিত। অভিমন্যুর অধর্মযুদ্ধে মৃত্যুর কথা আছে—দ্রোণেরও অবশ্য থাকিত। গল্পটা তখনও তৈয়ার হয় নাই, এজন্য নাই।
(৬) তার পর, দ্রোণপর্বের সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে দ্রোণযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে। তাহাতেও এই জুয়াচুরির কোন প্রসঙ্গ নাই। কেবল আছে যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণকে নিপাতিত করিলেন। এই অধ্যায়গুলি যখন প্রণীত হয়, তখনও গল্পটা তৈয়ার হয় নাই।
(৭) আশ্বমেধিক পর্বে আছে যে, কৃষ্ণও দ্বারকায় প্রত্যাগমন করিলে, বসুদেব কৃষ্ণের নিকট যুদ্ধবৃত্তান্ত শুনিতে ইচ্ছা করিলেন। কৃষ্ণ তাঁহাকে যুদ্ধবৃত্তান্ত সংক্ষেপে শুনাইলেন। দ্রোণযুদ্ধ সম্বন্ধে কৃষ্ণ ইহাই বলিলেন যে, দ্রোণাচার্যে ও ধৃষ্টদ্যুম্নে পাঁচ দিন যুদ্ধ হয়। পরিশেষে দ্রোণ সমরশ্রমে একান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নহস্তে নিহত হইলেন। বোধ হয়, এইটুকুই সত্য; এবং যুবার সহিত যুদ্ধে বৃদ্ধের শ্রান্তিই দ্রোণের যুদ্ধবিরতির যথার্থ কারণ। আর সকলই কবিকল্পনা বা উপন্যাস। নিতান্তই যে উপন্যাস, তাহার সাত রকম প্রমাণ দিলাম।
কিন্তু সেই উপন্যাস মধ্যে, কৃষ্ণকে মিথ্যা প্রবঞ্চনার প্রবর্তক বলিয়া স্থাপিত করিবার কারণ কি? কারণ পূর্বে বুঝাইয়াছি। বুঝাইয়াছি যে, যেমন জ্ঞান ঈশ্বরদত্ত, অজ্ঞান বা ভ্রান্তিও তাই। জয়দ্রথবধে কবি তাহা দেখাইয়াছেন। ভ্রান্তিও ঈশ্বরপ্রেরিত। ঘটোৎকচবধে কবি দেখাইয়াছেন যে, যেমন বুদ্ধি ঈশ্বরপ্রেরিত, দুর্বুদ্ধিও ঈশ্বরপ্রেরিত। আরও বুঝাইয়াছি যে, যেমন সত্যও ঈশ্বরের, অসত্যও তেমনই ঈশ্বরের। এই দ্রোণবধে কবি তাহাই দেখাইলেন।
ইহার পর, নারায়ণাস্ত্রমোক্ষ-পর্বাধ্যায়। সংক্ষেপে তাহার উল্লেখ করিয়াছি। বিস্তারিতের প্রয়োজন নাই, কেন না, নারায়ণাস্ত্র বৃত্তান্তটা অনৈসর্গিক, সুতরাং পরিত্যাজ্য। তবে এই পর্বাধ্যায়ে একটা রহস্যের কথা আছে।
দ্রোণ নিহত হইলে অর্জুন গুরুর জন্য শোকে অত্যন্ত কাতর। মিথ্যা কথা বলিয়া গুরুবধসাধনজন্য তিনি যুধিষ্ঠিরকে খুব তিরস্কার করিলেন, এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের নিন্দা করিলেন। যুধিষ্ঠির ভাল মানুষ, কিছু উত্তর করিলেন না, কিন্তু ভীম অর্জুনকে কড়া রকম কিছু শুনাইলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন অর্জুনকে আরও কড়া রকম শুনাইলেন। তখন অর্জুনশিষ্য যদুবংশীয়, সাত্যকি, অর্জুনের পক্ষ হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে ভারি রকম গালিগালাজ দিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন সুদ সমেত ফিরাইয়া দিলেন। তখন দুই জনে পরস্পরের বধে উদ্যত। কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম ও সহদেব থামাইয়া দিলেন। বিবাদটা এই যে, মিথ্যা কথা বলিয়া দ্রোণের মৃত্যুসাধন করা কর্তব্য ও অকর্তব্য কি না, এই তত্ত্ব লইয়া দুই পক্ষে যত কথা আছে, সব বলিলেন, কিন্তু কেহই কৃষ্ণকে ভাল মন্দ কিছুই বলিলেন না। কেহই বলিলেন না যে, কৃষ্ণের কথায় এরূপ হইয়াছে। কৃষ্ণের নামও কেহ করিলেন না। পাঁচ হাতের কাজ না হইলে এমন ঘটে না।