কৃষ্ণচরিত্র - ষষ্ঠ খণ্ড
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ—জয়দ্রথবধ
ভীষ্মের পর দ্রোণাচার্য সেনাপতি। দ্রোণপর্বে প্রথমে কৃষ্ণকে বিশেষ কোন কর্ম করিতে দেখা যায় না। তিনি নিপুণ সারথির ন্যায় কেবল সারথ্যই করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি যে কর্তা ও নেতা, এ কথাটা এখানে সত্য নহে। মধ্যে মধ্যে অর্জুন ও যুধিষ্ঠিরকে সদুপদেশ দেওয়া ভিন্ন তিনি আর কিছুই করেন নাই। দ্রোণাভিষেক-পর্বাধ্যায়ের একাদশ অধ্যায়ে সঞ্জয়কৃত কৃষ্ণের বলবীর্য ও মহিমা কীর্তন জন্য এক সুদীর্ঘ বক্তৃতা পাওয়া যায়। তাহাতে কোন প্রয়োজন নাই। এই অধ্যায়টি প্রক্ষিপ্ত বলিয়াই বোধ হয়, এবং কৃষ্ণের বলবীর্য ও মহিমা কীর্তনের মহাভারতে বা অন্যত্র কিছুই অভাবও নাই। আমরা তাঁহার মানবচরিত্র সমালোচনা করিতে ইচ্ছুক; মানবচরিত্র কার্যে প্রকাশ; অতএব আমরা কেবল কৃষ্ণকৃত কার্যেরই অনুসন্ধান করিব।
দ্রোণপর্বে প্রথম ভগদত্তবধে কৃষ্ণের কোন কার্য দেখিতে পাই। ভগদত্ত মহাবীর, পাণ্ডবপক্ষীয় আর কেহ তাঁহার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পারিল না; শেষ অর্জুন আসিয়া তাঁহার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ভগদত্ত অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে আপনাকে অশক্ত দেখিয়া, তাঁহার প্রতি বৈষ্ণবাস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন। অর্জুন বা অপর কেহই এই অস্ত্র নিবারণে সমর্থ নহেন; অতএব কৃষ্ণ অর্জুনকে আচ্ছাদিত করিয়া আপনি বক্ষে ঐ অস্ত্র গ্রহণ করিলেন। তাঁহার বক্ষে অস্ত্র বৈজয়ন্তী মালা হইয়া বিলম্বিত হইল।
এই অস্ত্র একটা অনৈসর্গিক অবোধগম্য ব্যাপার। যাহা অনৈসর্গিক তাহাতে আমরা পাঠককে বিশ্বাস করিতে বলি না এবং অনৈসর্গিকের উপর কোন সত্যও সংস্থাপিত হয় না। অতএব এ গল্পটা আমাদের পরিত্যাজ্য।
দ্রোণপর্বে, অভিমন্যুবধের পরে কৃষ্ণকে প্রকৃতপক্ষে কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ দেখিতে পাই। যে দিন সপ্ত রথী বেড়িয়া অন্যায়পূর্বক অভিমন্যুকে বধ করে, সে দিন কৃষ্ণার্জুন সে রণক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁহারা কৃষ্ণের নারায়ণী সেনার সঙ্গে যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন—ঐ সেনা কৃষ্ণ দুর্যোধনকে দিয়াছিলেন। এক পক্ষে তিনি নিজে, অন্য পক্ষে তাঁহার সেনা—এইরূপে তিনি উভয় পক্ষের সঙ্গে সাম্য রক্ষা করিযাছিলেন।
যুদ্ধান্তে ও দিবসান্তে শিবিরে ফিরিয়া আসিয়া কৃষ্ণার্জুন অভিমন্যুবধ বৃত্তান্ত শুনিলেন। অর্জুন অতিশয় শোককাতর হইলেন।* যোগেশ্বর কৃষ্ণ স্বয়ং শোকমোহের অতীত। তাঁহার প্রথম কার্য অর্জুনকে সান্ত্বনা করা। তিনি যে সকল কথা বলিয়া অর্জুনকে প্রবোধ দিলেন, তাহা তাঁহারই উপযুক্ত। গীতায় তিনি যে ধর্ম প্রচারিত করিয়াছেন, সেই ধর্মানুমোদিত মহাবাক্যের দ্বারা অর্জুনের শোকাপনয়ন করিলেন। ঋষিরা যুধিষ্ঠিরকে প্রবোধ দিতেছিলেন, এই বলিয়া যে, সকলেই মরিয়াছে ও সকলেই মরিয়া থাকে। তিনি তাহা বলিলেন না। তিনি বুঝাইলেন।
“যুদ্ধোপজীবী ক্ষত্রিয়গণের এই পথ। যুদ্ধমৃত্যুই ক্ষত্রিয়গণের সনাতন ধর্ম।”
কৃষ্ণ অভিমন্যুজননী সুভদ্রাকেও ঐ কথা বলিয়া প্রবোধ দিলেন। বলিলেন,
“সৎকুলজাত ধৈর্যশালী ক্ষত্রিয়ের যেরূপে প্রাণপরিত্যাগ করা উচিত, তোমার পুত্র সেইরূপে প্রাণত্যাগ করিয়াছে; অতএব শোক করিবার আবশ্যিকতা নাই। মহারথ, ধীর, পিতৃতুল্যপরাক্রমশালী অভিমন্যু ভাগ্যক্রমেই বীরগণের অভিলষিত গতি প্রাপ্ত হইয়াছে। মহাবীর অভিমন্যু ভূরি শত্রু সংহার করিয়া পুণ্যজনিত সর্বকামপ্রদ অক্ষয় লোকে গমন করিয়াছে। সাধুগণ, তপস্যা ব্রহ্মচর্য শাস্ত্র ও প্রজ্ঞা দ্বারা যেরূপ গতি অভিলাষ করেন, তোমার কুমারের সেইরূপ গতিলাভ হইয়াছে। হে সুভদ্রে! তুমি বীরজননী! বীরপত্নী, বীরনন্দিনী ও বীরবান্ধবা; অতএব তনয়ের নিমিত্ত তোমার শোকাকুল হওয়া উচিত নহে।”
* এমনও পাঠক থাকিতে পারেন যে, তাঁহাকে বলিয়া দিতে হয় যে, অভিমন্যু অর্জুনের পুত্র ও কৃষ্ণের ভাগিনেয়।