শৈবলিনী কোন উত্তর করিল না; অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল। অঙ্গুলিনির্দেশানুসারে সুন্দরী দেখিল, পুষ্করিণীর অপর পারে, এক তালবৃক্ষতলে, সর্বনাশ! সুন্দরী আর কথা না কহিয়া কক্ষ হইতে কলস ভূমে নিক্ষিপ্ত করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। পিত্তল কলস, গড়াইতে গড়াইতে ঢক ঢক শব্দে উদরস্থ জল উদ্র‌গীর্ণ করিতে করিতে, পুনর্বার বাপীজলমধ্যে প্রবেশ করিল।

সুন্দরী তালবৃক্ষতলে একটি ইংরেজ দেখিতে পাইয়াছিল।

ইংরেজকে দেখিয়া শৈবলিনী হেলিল না—দুলিল না—জল হইতে উঠিল না। কেবল বক্ষঃ পর্যন্ত জলমধ্যে নিমজ্জন করিয়া আর্দ্র বসনে কবরী সমেত মস্তকের অর্ধভাগ মাত্র আবৃত করিয়া প্রফুল্লরাজীববৎ জলমধ্যে বসিয়া রহিল। মেঘমধ্যে, অচলা সৌদামিনী হাসিল—ভীমার সেই শ্যামতরঙ্গে এই স্বর্ণকমল ফুটিল।

সুন্দরী পলাইয়া গেল, কেহ নাই দেখিয়া ইংরেজ ধীরে ধীরে তালগাছের অন্তরালে থাকিয়া, ঘাটের নিকটে আসিল।

ইংরেজ, দেখিতে অল্পবয়স্ক বটে। গুম্ফ বা শ্মশ্রু কিছুই ছিল না। কেশ ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ; চক্ষুও ইংরেজের পক্ষে কৃষ্ণাভ। পরিচ্ছদের বড় জাঁকজমক, এবং চেন্ অঙ্গুরীয় প্রভৃতি অলঙ্কারের কিছু পারিপাট্য ছিল।

ইংরেজ ধীরে ধীরে ঘাটে আসিয়া, জলের নিকটে আসিয়া, বলিল, “I come again fair lady.”

শৈবলিনী বলিল, “আমি ও ছাই বুঝিতে পারি না |”

“Oh—ay—that nasty gibberish—I must speak it I suppose. হম again আয়া হ্যায় |”

শৈ। কেন? যমের বাড়ীর কি এই পথ?

ইংরেজ না বুঝিতে পারিয়া কহিল, “কিয়া বোল্‌তা হ্যায়?”

শৈ। বলি, যম কি তোমায় ভুলিয়া গিয়াছে?

ইংরেজ। যম! John you mean? হম জন নহি, হম লরেন্স।

শৈ। ভাল, একটা ইংরেজি কথা শিখিলাম, লরেন্স অর্থ বাঁদর।

সেই সন্ধ্যাকালে শৈবলিনীর কাছে লরেন্স ফষ্টর কতকগুলি দেশী গালি খাইয়া স্বস্থানে ফিরিয়া গেল। লরেন্স ফষ্টর, পুষ্করিণীর পাহাড় হইতে অবতরণ করিয়া আম্রবৃক্ষতল হইতে অশ্বমোচন করিয়া, তৎপৃষ্ঠে আরোহণপূর্বক টিবিয়ট নদীর তীরস্থ পর্বতপ্রতিধ্বনি সহিত শ্রুত গীতি স্মরণ করিতে করিতে চলিলেন। এক একবার মনে হইতে লাগিল, “সেই শীতল দেশের তুষাররাশির সদৃশ যে মেরি ফষ্টরের প্রণয়ে বাল্যকালে অভিভূত হইয়াছিলাম, এখন সে স্বপ্নের মত। দেশভেদে কি রুচিভেদ জন্মে? তুষারময়ী মেরী কি শিখারূপিণী উষ্ণ দেশের সুন্দরীর তুলনীয়া? বলিতে পারি না |”

ফষ্টর চলিয়া গেলে শৈবলিনী ধীরে ধীরে জল কলসপূর্ণ করিয়া কুম্ভকক্ষে বসন্তপবনারূঢ় মেঘবৎ মন্দপদে গৃহে প্রত্যাগমন করিল। যথাস্থানে জল রাখিয়া শয্যাগৃহে প্রবেশ করিল। তথায় শৈবলিনীর স্বামী চন্দ্রশেখর কম্বলাসনে উপবেশন করিয়া, নামাবলীতে কটিদেশের সহিত উভয়ে জানু বন্ধন করিয়া মৃৎপ্রদীপ সম্মুখে, তুলটে হাতে-লেখা পুতি পড়িতেছিলেন। আমরা যখনকার কথা বলিতেছি, তাহার পর এক শত দশ বৎসর অতীত হইয়াছে।

চন্দ্রশেখরের বয়ঃক্রম প্রায় চত্বারিংশৎ বর্ষ। তাঁহার আকার দীর্ঘ; তদুপযোগী বলিষ্ঠ গঠন। মস্তক বৃহৎ, ললাট প্রশস্ত, তদুপরি চন্দন-রেখা।

শৈবলিনী গৃহপ্রবেশকালে মনে মনে ভাবিতেছিলেন, ‘যখন ইনি জিজ্ঞাসা করিবেন, কেন এত রাত্র হইল, তখন কি বলিব?’ কিন্তু শৈবলিনী গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলে, চন্দ্রশেখর কিছু বলিলেন না। তখন তিনি ব্রহ্মসূত্রের সূত্রবিশেষের অর্থসংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। শৈবলিনী হাসিয়া উঠিল।