কৃষ্ণচরিত্র - পঞ্চম খণ্ড
কর্মবাদ কৃষ্ণের পূর্বেও প্রচলিত ছিল, কিন্তু সে প্রচলিত মতানুসারে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডই কর্ম। মনুষ্যজীবনের সমস্ত অনুষ্ঠেয় কর্ম, যাহাকে পাশ্চাত্ত্যেরা Duty, বলেন—সে অর্থে সে প্রচলিত ধর্মে “কর্ম” শব্দ ব্যবহৃত হইত না। গীতাতেই আমরা দেখি, কর্ম শব্দের পূর্বপ্রচলিত অর্থ পরিবর্তিত হইয়া, যাহা কর্তব্য, যাহা অনুষ্ঠেয়, যাহা Duty, সাধারণতঃ তাহাই কর্ম নাম প্রাপ্ত হইয়াছে। আর এইখানে হইতেছে। ভাষাগত বিশেষ প্রভেদ আছে—কিন্তু মর্মার্থ এক। এখানে যিনি বক্তা, গীতাতেও তিনিই প্রকৃত বক্তা, এ কথা স্বীকার করা যাইতে পারে।
অনুষ্ঠেয় কর্মের যথাবিহিত নির্বাহের অর্থাৎ ডিউটির সম্পাদনের নামান্তর স্বধর্মপালন। গীতার প্রথমেই শ্রীকৃষ্ণ স্বধর্মপালনে অর্জুনকে উপদিষ্ট করিতেছেন। এখানেও কৃষ্ণ সেই স্বধর্মপালনের উপদেশ দিতেছেন। যথা,
“হে সঞ্জয়! তুমি কি নিমিত্ত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য প্রভৃতি সকল লোকের ধর্ম সবিশেষ জ্ঞাত হইয়াও কৌরবগণের হিতসাধন মানসে পাণ্ডবদিগের নিগ্রহ চেষ্টা করিতেছ? ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বেদজ্ঞ, অশ্বমেধ ও রাজসূয়জ্ঞের অনুষ্ঠানকর্তা। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী এবং হস্ত্যশ্বরথচালনে সুনিপুণ। এক্ষণে যদি পাণ্ডবেরা কৌরবগণের প্রাণহিংসা না করিয়া ভীমসেনকে সান্ত্বনা করতঃ রাজ্যলাভের অন্য কোন উপায় অবধারণ করিতে পারেন, তাহা হইলে ধর্মরক্ষা ও পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান হয়। অথবা ইঁহারা যদি ক্ষত্রিয়ধর্ম প্রতিপালনপূর্বক স্বকর্ম সংসাধন করিয়া দুরদৃষ্টবশতঃ মৃত্যুমুখে নিপতিত হন, তাহাও প্রশস্ত। বোধ হয়, তুমি সন্ধিসংস্থাপনই শ্রেয়সাধন বিবেচনা করিতে; কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ক্ষত্রিয়দিগের যুদ্ধে ধর্মরক্ষা হয়, কি যুদ্ধ না করিলে ধর্মরক্ষা হয়? ইহার মধ্যে যাহা শ্রেষ্ঠ বলিয়া বিবেচনা করিবে, আমি তাহারই অনুষ্ঠান করিব।”
তার পর শ্রীকৃষ্ণ চতুর্বণের ধর্মকথনে প্রবৃত্ত হইলেন। গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের যেরূপ ধর্ম কথিত হইয়াছে—এখানেও ঠিক সেইরূপ। এইরূপ মহাভারতে অন্যত্রও ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যায় যে, গীতোক্ত ধর্ম, এবং মহাভারতের অন্যত্র কথিত কৃষ্ণোক্ত ধর্ম এক। অতএব গীতোক্ত ধর্ম যে কৃষ্ণোক্ত ধর্ম—সে ধর্ম যে কেবল কৃষ্ণের নামে পরিচিত, এমন নহে—যথার্থই কৃষ্ণপ্রণীত ধর্ম, ইহা এক প্রকার সিদ্ধ। কৃষ্ণ সঞ্জয়কে আরও অনেক কথা বলিলেন। তাহার দুই একটা কথা উদ্ধৃত করিব।
ইউরোপীয়দিগের বিবেচনায় পররাজ্যাপহরণ অপেক্ষা গৌরবের কর্ম কিছুই নাই। উহার নাম “Conquest,” “Glory,” “Extension of Empire” ইত্যাদি ইত্যাদি। যেমন ইংরেজিতে, ইউরোপীয় অন্যান্য ভাষাতেও ঠিক সেইরূপ পররাজ্যাপহরণের গুণানুবাদ। শুধু এক “Glorie” শব্দের মোহে মুগ্ধ হইয়া প্রুষিয়ার দ্বিতীয় ফ্রেড্রীক তিন বার ইউরোপে সমরানল জ্বালিয়া লক্ষ লক্ষ মনুষ্যের সর্বনাশের কারণ হইয়াছিলেন। ঈদৃশ রুধিরপিপাসু রাক্ষস ভিন্ন অন্য ব্যক্তির সহজেই বোধ হয় যে, এইরূপ “Glorie” ও তস্করতাতে প্রভেদ আর কিছুই নাই—কেবল পররাজ্যাপহারক বড় চোর, অন্য চোর ছোট চোর।* কিন্তু এ কথাটা বলা বড় দায়, কেন না, দিগ্বিজয়ের এমনই একটা মোহ আছে যে, আর্য ক্ষত্রিয়েরাও মুগ্ধ হইয়া অনেক সময় ধর্মাধর্ম ভুলিয়া যাইতেন। ইউরোপে কেবল Diogenes মহাবীর আলেকজণ্ডরকে বলিয়াছিলেন, “তুমি এক জন বড় দস্যু মাত্র।” ভারতবর্ষেও শ্রীকৃষ্ণ পররাজ্যলোলুপ রাজাদিগকে তাই বলিতেছেন,—তাঁহার মতে ছোট চোর লুকাইয়া চুরি করে, বড় চোর প্রকাশ্যে চুরি করে। তিনি বলিতেছেন,
* তবে যেখানে কেবল পরোপকারার্থ পরের রাজ্য হস্তগত করা যায়, সেখানে নাকি ভিন্ন কথা হইতে পারে। সেরূপ কার্যের বিচারে আমি সক্ষম নহি-কেন না, রাজনীতিজ্ঞ নহি।