এখনও যদি কোন পাঠকের বিশ্বাস থাকে যে, বর্তমান জরাসন্ধবধ—পর্বাধ্যায়ের সমুদায় অংশই মূল মহাভারতের অন্তর্গত এবং একব্যক্তি প্রণীত, এবং কৃষ্ণাদি যথার্থই ছদ্মবেশে গিরিব্রজে আসিয়াছিলেন, তবে তাঁহাকে অনুরোধ করি, হিন্দুদিগের পুরাণেতিহাস মধ্যে ঐতিহাসিক তত্ত্বের অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া অন্য শাস্ত্রের আলোচনায় প্রবৃত্ত হউন। এদিকে কিছু হইবে না।

অতঃপর, জরাসন্ধবধের অবশিষ্ট কথাগুলি বলিয়া এ পর্বাধ্যায়ের উপসংহার করিব; সে সকল খুব সোজা কথা।

জরাসন্ধ যুদ্ধার্থ ভীমকে মনোনীত করিলে, জরাসন্ধ “যশস্বী ব্রাহ্মণ কর্তৃক কৃত-স্বস্ত্যয়ন হইয়া ক্ষত্রধর্মানুসারে বর্ম ও কিরীট পরিত্যাগ পূর্বক” যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। “তখন যাবতীয় পুরবাসী ব্রাহ্মণ ঐত্রিয় বৈশ্য শূদ্র বণিতা ও বৃদ্ধগণ তাঁহাদের সংগ্রাম দেখিতে তথায় উপস্থিত হইলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে জনতা দ্বারা সমাকীর্ণ হইল।” “চতুর্দশ দিবস যুদ্ধ হইল!” (যদি সত্য হয়, বোধ হয় তবে মধ্যে মধ্যে অবকাশমত যুদ্ধ হইত) চতুর্দশ দিবসে “বাসুদেব জরাসন্ধকে ক্লান্ত দেখিয়া ভীমকর্মা ভীমসেনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে কৌন্তেয়! ক্লান্ত শত্রুকে পীড়ন করা উচিত নহে; অধিকতর পীড্যমান হইলে জীবন পরিত্যাগ করে। অতএব ইনি তোমার পীড়নীয় নহেন। হে ভরতর্ষভ, ইঁহার সহিত বাহুযুদ্ধ কর।” (অর্থাৎ যে শত্রুকে ধর্মতঃ বধ করিতে হইবে, তাহাকেও পীড়ন কর্তব্য নহে।) ভীম জরাসন্ধকে পীড়ন করিয়াই বধ করিলেন। ভীমের ধর্মজ্ঞান কৃষ্ণের তুল্য হইতে পারে না।

তখন কৃষ্ণার্জুন ও ভীম কারাবদ্ধ মহীপালগণকে বিমুক্ত করিলেন। তাহাই জরাসন্ধবধের একমাত্র উদ্দেশ্য। অতএব রাজগণকে মুক্ত করিয়া আর কিছুই করিলেন না, দেশে চলিয়া গেলেন। তাঁহারা Annexationist ছিলেন না—পিতার অপরাধে পুত্রের রাজ্য অপহরণ করিতেন না, তাঁহারা জরাসন্ধকে বিনষ্ট করিয়া জরাসন্ধপুত্র সহদেবকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। সহদেব কিছু নজর দিল, তাহা গ্রহণ করিলেন। কারামুক্ত রাজগণ কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিলেন,

“এক্ষণে এই ভৃত্যদিগকে কি করিতে হইবে অনুমতি করুন।”

কৃষ্ণ তাঁহাদিগকে কহিলেন, “রাজা যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করিতে অভিলাষ করিয়াছেন, আপনারা সেই সাম্রাজ্য-চিকীর্ষু ধার্মিকের সাহায্য করেন, ইহাই প্রার্থনা।”

যুধিষ্ঠিরকে কেন্দ্রস্থিত করিয়া ধর্মরাজ্য সংস্থাপন করা, কৃষ্ণের এক্ষণে জীবনের উদ্দেশ্য। অতএব প্রতি পদে তিনি তাহার উদ্যোগ করিতেছেন।

এই জরাসন্ধবধে কৃষ্ণচরিত্রের বিশেষ মহিমা প্রকাশমান—কিন্তু পরবর্তী লেখকদিগের দৌরাত্ম্যে ইহা বড় জটিল হইয়া পড়িয়াছে। ইহার পর শিশুপালবধ। সেখানে আরও গণ্ডগোল।