কৃষ্ণচরিত্র - চতুর্থ খণ্ড
পাঠক দেখুন, কৃষ্ণের আত্মীয়গণ যাঁহারা প্রত্যহ তাঁহার কার্যকলাপ দেখিতেন, তাঁহারা কৃষ্ণকে কি ভাবিতেন।* আর এখন আমরা তাঁহাকে কি ভাবি। তাঁহারা জানিতেন, কৃষ্ণ কাম-ক্রোধ-বিবর্জিত, সর্বাপেক্ষা সত্যবাদী, সর্বদোষরহিত, সর্বলোকোত্তম, সর্বজ্ঞ ও সর্বকৃৎ,—আমরা জানি, তিনি লম্পট, ননীমাখনচোর, কুচক্রী, মিথ্যাবাদী, রিপুবশীভূত এবং অন্যান্য দোষযুক্ত। যিনি ধর্মের চরমাদর্শ বলিয়া প্রাচীন গ্রন্থে পরিচিত, তাঁহাকে যে জাতি এ পদে অবনত করিয়াছে, সে জাতির মধ্যে যে ধর্মলোপ হইবে, বিচিত্র কি?
যুধিষ্ঠির যাহা ভাবিয়াছিলেন, ঠিক তাহাই ঘটিল; যে অপ্রিয় সত্যবাক্য আর কেহই যুধিষ্ঠিরকে বলে নাই, কৃষ্ণ তাহা বলিলেন। মিষ্ট কথার আবরণ দিয়া যুধিষ্ঠিরকে তিনি বলিলেন, “তুমি রাজসূয়ের অধিকারী নও, কেন না, সম্রাট্ ভিন্ন রাজসূয়ের অধিকার হয় না, তুমি সম্রাট নও। মগধাধিপতি জরাসন্ধ এখন সম্রাট্। তাহাকে জয় না করিলে তুমি রাজসূয়ের অধিকারী হইতে পার না ও সম্পন্ন করিতে পারিবে না।”
যাঁহারা কৃষ্ণকে স্বার্থপর ও কুচক্রী ভাবেন, তাঁহারা এই কথা শুনিয়া বলিবেন, “এ কৃষ্ণের মতই কথাটা হইল বটে। জরাসন্ধ কৃষ্ণের পূর্বশত্রু, কৃষ্ণ নিজে তাঁহাকে আঁটিয়া উঠিতে পারেন নাই; এখন সুযোগ পাইয়া বলবান্ পাণ্ডবদিগের দ্বারা তাহার বধ-সাধন করিয়া আপনার ইষ্টসিদ্ধির চেষ্টায় এই পরামর্শটা দিলেন।”
কিন্তু আরও একটু কথা বাকি আছে। জরাসন্ধ সম্রাট্, কিন্তু তৈমুরলঙ্গ্ বা প্রথম নেপোলিয়নের ন্যায় অত্যাচারকারী সম্রাট্। পৃথিবী তাহার অত্যাচারে প্রপীড়িত। জরাসন্ধ রাজসূয়যজ্ঞার্থ প্রতিজ্ঞা করিয়া, “বাহুবলে সমস্ত ভূপতিগণকে পরাজয় করিয়া সিংহ যেমন পর্বতকন্দর-মধ্যে করিগণকে বদ্ধ রাখে, সেইরূপ তাঁহাদিগকে গিরিদুর্গে বদ্ধ রাখিয়াছে।” রাজগণকে কারাবদ্ধ করিয়া রাখার আর এক ভয়ানক তাৎপর্য ছিল। জরাসন্ধের অভিপ্রায়, সেই সমানীত রাজগণকে যজ্ঞকালে সে মহাদেবের নিকট বলি দিবে। পূর্বে যে যজ্ঞকালে কেহ কখনও নরবলি দিত, তাহা ইতিহাসজ্ঞ পাঠককে বলিতে হইবে না।# কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলিতেছেন,
“হে ভরতকুলপ্রদীপ! বলিপ্রদানার্থ সমানীত ভূপতিগণ প্রোক্ষিপ্ত ও প্রমৃষ্ট হইয়া পশুদিগের ন্যায় পশুপতির গৃহে বাস করতঃ অতি কষ্টে জীবন ধারণ করিতেছেন। দুরাত্মা জরাসন্ধ তাঁহাদিগকে অচিরাৎ ছেদন করিবে, এই নিমিত্ত আমি তাহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে উপদেশ দিতেছি। ঐ দুরাত্মা ষড়শীতি জন ভূপতিকে আনয়ন করিয়াছে, কেবল চতুর্দশ জনের অপ্রতুল আছে; চতুর্দশ জন আনীত হইলেই ঐ নৃপাধম উহাদের সকলকে এককালে সংহার করিবে। হে ধর্মাত্মন্! এক্ষণে যে ব্যক্তি দুরাত্মা জরাসন্ধের ঐ ক্রূর কর্মে বিঘ্ন উৎপাদন করিতে পারিবেন, তাহার যশোরাশি ভূমণ্ডলে দেদীপ্যমান হইবে, এবং যিনি উহাকে জয় করিতে পারিবেন, তিনি নিশ্চয় সাম্রাজ্য লাভ করিবেন।”
* যুধিষ্ঠিরের মুখ হইতে বাস্তবিক এই কথাগুলি বাহির হইয়াছিল, আর তাহাই কেহ লিখিয়া রাখিয়াছে, এমত নহে। মৌলিক মহাভারতে তাঁহার কিরূপ চরিত্র প্রচারিত হইয়াছিল, ইহাই আমাদের আলোচ্য।
# কেহ কদাচিৎ দিত-সামাজিক প্রথা ছিল না। কৃষ্ণ এক স্থানে বলিতেছেন, “আমরা কখন নরবলি দেখি নাই।” ধার্মিক ব্যক্তিরা এ ভয়ানক প্রথার দিক্ দিয়া যাইতেন না।
# কেহ কদাচিৎ দিত-সামাজিক প্রথা ছিল না। কৃষ্ণ এক স্থানে বলিতেছেন, “আমরা কখন নরবলি দেখি নাই।” ধার্মিক ব্যক্তিরা এ ভয়ানক প্রথার দিক্ দিয়া যাইতেন না।