সায়নাচার্য কাম্পিলবাসিনীর এইরূপ অর্থ করেন— “কাম্পিলশব্দেন শ্ল্যাঘ্যো বস্ত্রবিশেষ উচ্যতে” কিন্তু বেবর সাহেবের বিশ্বাস যে, তিনি সায়নাচার্যের অপেক্ষা সংস্কৃত বুঝেন ভাল, অতএব তিনি এ ব্যাখ্যা গ্রাহ্য করেন না, তাহা না-ই করুন, কিন্তু কাম্পিলবাসিনী কোন স্ত্রীর নাম সুভদ্রা ছিল বলিয়া কৃষ্ণভগিনীর নাম কেন সুভদ্রা হইতে পারে না, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। যে রাজাই অশ্বমেধ যজ্ঞ করুন, তাঁহারই মহিষীকে এই মন্ত্র পাঠ করিতে হইবে, তাঁহাকেই বলিতে হইবে, ৺“আমি কাম্পিলবাসিনী সুভদ্রা”। সুভদ্রা শব্দে সামশ্রয়ী মহাশয় এই অর্থ করেন,—কল্যাণী অর্থাৎ সৌভাগ্যবতী। মহীধর বলেন,—কাম্পিলনগরীর মহিলাগণ অতিশয় রূপলাবণ্যবতী। অতএব এই মন্ত্রের অর্থ এই যে, “আমি সৌভাগ্যবতী ও রূপলাবণ্যবতী হইয়াও এই অশ্বের নিকট সমাগত হইয়াছি।” অতএব বুঝিতে পারি না যে, এই মন্ত্রের বলে কৃষ্ণভগিনী অর্জুনপত্নী সুভদ্রার পরিবর্তে কেন একজন পাঞ্চালী সুভদ্রাকে কল্পনা করিতে হইবে। যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার বহুপূর্ববর্তী রাজগণও অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়াছিলেন, ইহাই মহাভারতে এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। অতএব ইহাই সম্ভব যে, অশ্বমেধ যজ্ঞের এই যজুর্মন্ত্র কৃষ্ণ-পাণ্ডবের অপেক্ষা প্রাচীন। এখন যেমন লোকে আধুনিক লেখকদিগের কাব্যগ্রন্থ হইতে পুত্রকন্যার নামকরণ করিতেছে,* তেমনি সে কালেও বেদ হইতে লোকের পুত্রকন্যার নাম রাখা অসম্ভব নহে। এই মন্ত্র হইতেই কাশিরাজ আপনার তিনটি কন্যার নাম অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা রাখিয়া থাকিবেন, এবং এইরূপেই কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রারও নামকরণ হইয়া থাকিবে। এই মন্ত্রে এমন কিছু দেখি না যে, তজ্জন্য কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা কেহ ছিলেন না, এমন কথা অনুমান করা যায়। অতএব আমরা সুভদ্রাহরণের বিচারে প্রবৃত্ত হইব।

এক্ষণে, সুভদ্রাহরণের নৈতিক বিচারে প্রবৃত্ত হইবার আগে পাঠকের নিকট একটা অনুরোধ আছে। তিনি কাশীদাসের গ্রন্থে অথবা কথকের নিকট, অথবা পিতামহীর মুখে, অথবা বাঙ্গালা নাটকাদিতে যে সুভদ্রাহরণ পড়িয়াছেন বা শুনিয়াছেন, তাহা অনুগ্রহপূর্বক ভুলিয়া যাউন। অর্জুনকে দেখিয়া সুভদ্রা অনঙ্গশরে ব্যথিত হইয়া উন্মত্ত হইলেন, সত্যভামা মধ্যবর্তিনী দূতী হইলেন, অর্জুন সুভদ্রাকে হরণ করিয়া লইয়া গেলে যাদবসেনার সঙ্গে তাঁর ঘোরতর যুদ্ধ হইল, সুভদ্রা তাঁহার সারথি হইয়া গগনমার্গে তাঁহার রথ চালাইতে লাগিলেন— সে সকল কথা ভুলিয়া যান। এ সকল অতি মনোহর কাহিনী বটে, কিন্তু মূল মহাভারতে ইহার কিছুই নাই। ইহা কাশীরাম দাসের গ্রন্থেই প্রথম দেখিতে পাই, কিন্তু এ সকল তাঁহার সৃষ্টি কি তাঁহার পরবর্তী কথকদিগের সৃষ্টি, তাহা বলা যায় না। সংস্কৃত মহাভারতে যে প্রকার সুভদ্রাহরণ কথিত হইয়াছে, তাহার স্থূলমর্ম বলিতেছি।

দ্রৌপদীর বিবাহের পর পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থে সুখে রাজ্য করিতেছিলেন, কোন কারণে অর্জুন দ্বাদশ বৎসরের জন্য ইন্দ্রপ্রস্থ পরিত্যাগপূর্বক বিদেশে ভ্রমণ করেন। অন্যান্য দেশপর্যটনানন্তর শেষে তিনি দ্বারকায় উপস্থিত হয়েন। তথায় যাদবেরা তাঁহার বিশেষ সমাদর ও সৎকার করেন। অর্জুন কিছু দিন সেখানে অবস্থিতি করেন। একদা যাদবেরা রৈবতক পর্বতে একটা মহান্ উৎসব আরম্ভ করেন। সেখানে যদুবীরেরা ও যদুকুলাঙ্গনাগণ সকলেই উপস্থিত হইয়া আমোদ আহ্লাদ করেন। অন্যান্য স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে সুভদ্রাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি কুমারী ও বালিকা। অর্জুন তাঁহাকে দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন। কৃষ্ণ তাহা জানিতে পারিয়া অর্জুনকে বলিলেন, “সখে! বনচর হইয়াও অনঙ্গশরে চঞ্চল হইলে?” অর্জুন অপরাধ স্বীকার করিয়া, সুভদ্রা যাহাতে তাঁহার মহিষী হন, তদ্বিষয়ে কৃষ্ণের পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। কৃষ্ণ যে পরামর্শ দিলেন তাহা এই :—

* যথা- প্রমীলা, মৃণালিনী ইত্যাদি।