কৃষ্ণচরিত্র - তৃতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ—কংসবধ
এদিকে কংসের নিকট সংবাদ পঁহুছিল যে, বৃন্দাবনে কৃষ্ণ বলরাম অতিশয় বলশালী হইয়াছেন। পূতনা হইতে অরিষ্ট পর্যন্ত কংসানুচর সকলকে নিহত করিয়াছেন। দেবর্ষি নারদ গিয়া কংসকে বলিলেন, কৃষ্ণ-রাম বসুদেবের পুত্র। দেবকীর অষ্টমগর্ভজা বলিয়া যে কন্যাকে কংস নিহত করিয়াছিলেন, সে নন্দ—যশোদার কন্যা। বসুদেব সন্তান পরিবর্তিত করিয়া কৃষ্ণকে নন্দালয়ে গোপনে রাখিয়াছেন। ইহা শুনিয়া কংস ভীত ও ক্রুদ্ধ হইয়া বসুদেবকে তিরস্কৃত করিলেন, এবং তাঁহার বধে উদ্যত হইলেন; এবং রাম-কৃষ্ণকে আনিবার জন্য অক্রুরনামা এক জন যাদবপ্রধানকে বৃন্দাবনে প্রেরণ করিলেন। এ দিকে কংস আপনার বিখ্যাত বলবান্ মল্লদিগের দ্বারা রাম-কৃষ্ণের বধসাধনের অভিপ্রায়ে ধনুর্মখ নামে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেন। রামকৃষ্ণ অক্রূর কর্তৃক তথায় আনীত হইয়া* রঙ্গভূমিতে প্রবেশপূর্বক কংসের শিক্ষিত হস্তী কুবলয়াপীড়কে ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ মল্ল চাণুর ও মুষ্ঠিককে নিহত করিলেন। ইহা দেখিয়া কংস নন্দকে লৌহময় নিগড়ে অবরুদ্ধ করিবার এবং বসুদেবকে বিনাশ করিবার জন্য আদেশ করিয়া কৃষ্ণ-বলরামকে তাড়াইয়া দিবার আজ্ঞা করিলেন। তখন যে মঞ্চে মল্লযুদ্ধ দেখিবার জন্য অন্যান্য যাদবের সহিত কংস উপবিষ্ট ছিলেন, কৃষ্ণ লম্ফপ্রদান-পূর্বক তদুপরি আরোহণ করিয়া কংসকে ধরিলেন এবং তাঁহাকে কেশের দ্বারা আকর্ষণ করিয়া রঙ্গভূমে নিপাতিত ও তাঁহাকে নিহত করিলেন। পরে বসুদেবকে দেবকী প্রভৃতি গুরুজনকে যথাবিহিত বন্দনা করিয়া কংসের পিতা উগ্রসেনকে রাজ্যে অভিষেক করিলেন। নিজে রাজা হইলেন না।
হরিবংশ ও পুরাণ সকলে এইরূপ কংসবৃত্তান্ত কথিত হইয়াছে। কংসবধ ঐতিহাসিক ঘটনা বটে, কিন্তু তদ্বিষয়ক এই বিবরণ ঐতিহাসিকতাশূন্য। ইহাতে বিশ্বাস করিতে গেলে, অতিপ্রকৃত ব্যাপারে বিশ্বাস করিতে হয়। প্রথমতঃ দেবর্ষি নারদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিতে হয়। তার পর সেই দৈববাণীতে বিশ্বাস করিতে হয়, কেন না, কংসের ভয় সেই দৈববাণীস্মৃতি হইতে উৎপন্ন। তাহা ছাড়া, দুইটি গোপবালক আসিয়া বিনা যুদ্ধে সভামধ্যে মথুরাধিপতিকে বিনষ্ট করিবে, ইহা ত সহজে বিশ্বাস করা যায় না। অতএব দেখা যাউক যে, সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতে এই বিষয় কি আছে। মহাভারতের সভাপর্বে জরাসন্ধবধ-পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ নিজে নিজের পূর্ববৃত্তান্ত যুধিষ্ঠিরের নিকট বলিতেছেন:—
* পথিমধ্যে কুব্জা-ঘটিত ব্যাপারটা আছে। বিষ্ণুপুরাণে নিন্দনীয় কথা কিছু নাই। কুব্জা আপনাকে সুন্দরী হইতে দেখিয়া কৃষ্ণকে নিজ মন্দিরে যাইতে অনুরোধ করিলেন, কৃষ্ণ হাসিয়াই অস্থির। বিষ্ণুপুরাণে এই পর্যন্ত। কৃষ্ণের এ ব্যবহার মানবোচিত ও সজ্জনোচিত। কিন্তু ভাগবতকার ও ব্রহ্মবৈবর্তকার তাহাতে সন্তুষ্ট নহেন, কুব্জার হঠাৎ ভক্তির হঠাৎ পুরস্কার দিয়াছেন, শেষ যাত্রায় কুব্জাপাটরাণী!
আমরা এইখান হইতে ভাগবতের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম। তাহার কারণ, ভাগবতে ঐতিহাসিক কথা কিছুই পাওয়া যায় না; যাহা পাওয়া যায়, তাহা বিষ্ণুপুরাণেও আছে। তদতিরিক্ত যাহা পাওয়া যায়, তাহা অতিপ্রকৃত উপন্যাস মাত্র। তবে ভাগবতকথিত বাল্যলীলা অতি প্রসিদ্ধ বলিয়া, আমরা ভাগবতের সে অংশের পরিচয় দিতে বাধ্য হইয়াছি। এক্ষণে ভাগবতের নিকট বিদায় গ্রহণ করিতে পারি।