কৃষ্ণচরিত্র - দ্বিতীয় খণ্ড
বেদান্তের যাহা মায়াবাদ সাঙ্খ্যে তাহা প্রকৃতিবাদ। প্রকৃতি হইতে শক্তিবাদ। এই কয়টি শ্লোকে শক্তিবাদ এবং অদ্বৈতবাদ মিলিত হইল। বোধ হয়, ইহাই স্মরণ রাখিয়া ব্রহ্মবৈবর্তকার লিখিয়াছেন যে, কৃষ্ণ রাধাকে বলিতেছেন যে, তুমি না থাকিলে, আমি কৃষ্ণ, এবং তুমি থাকিলে আমি শ্রীকৃষ্ণ। বিষ্ণুপুরাণকথিত এই শ্রী লইয়াই তিনি শ্রীকৃষ্ণ। পাঠক দেখিবেন, বিষ্ণুপুরাণে যাহা শ্রী সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে, ব্রহ্মবৈবর্তে রাধা সম্বন্ধে ঠিক তাহাই কথিত হইয়াছে। রাধা সেই শ্রী। পরিচ্ছেদের উপর আমি শিরোনাম দিয়াছি, “শ্রীরাধা”। রাধা ঈশ্বরের শক্তি, উভয়ের বিধিসম্পাদিত পরিণয়, শক্তিমানের শক্তির স্ফূর্তি, এবং শক্তিরই বিকাশ উভয়ের বিহার।
যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এক্ষণে বিদ্যমান আছে, তৎকথিত ‘রাধাতত্ত্ব’ কি, তাহা বোধ করি এতক্ষণে পাঠককে বুঝাইতে পারিলাম। কিন্তু আদিম ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ‘রাধাতত্ত্ব’ ছিল কি? বোধ হয় ছিল; কিন্তু এ প্রকার নহে। বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্তে রাধা শব্দের ব্যুৎপত্তি অনেক প্রকার দেওয়া হইয়াছে। তাহার দুইটি পূর্বে ফুটনোটে উদ্ধৃত করিয়াছি, আর একটি উদ্ধৃত করিতেছি:—
“রেফো হি কোটিজন্মাঘং কর্মভোগং শুভাশুভম্।
আকারো গর্ভবাসঞ্চ মৃত্যুঞ্চ রোগমুৎসৃজেৎ || ১০৬ ||
ধকার আয়ুষো হানিমাকারো ভববন্ধনম্।
শ্রবণস্মরণোক্তিভ্যঃ প্রণশ্যতি ন সংশয়ঃ || ১০৭ ||
রাকারো নিশ্চলাং ভক্তিং দাস্যং কৃষ্ণপদাম্বুজে।
সর্বেস্পিতং সদানন্দং সর্বসিদ্ধৌঘমীশ্বরম্ || ১০৮ ||
ধকারঃ সহবাসঞ্চ তত্তুল্যকালমেব চ।
দদাতি সার্ষ্টিং সারূপ্যং তত্ত্বজ্ঞানং হরেঃ সমম্ || ১০৯ ||”
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম্, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে, ১৩ অঃ।
আকারো গর্ভবাসঞ্চ মৃত্যুঞ্চ রোগমুৎসৃজেৎ || ১০৬ ||
ধকার আয়ুষো হানিমাকারো ভববন্ধনম্।
শ্রবণস্মরণোক্তিভ্যঃ প্রণশ্যতি ন সংশয়ঃ || ১০৭ ||
রাকারো নিশ্চলাং ভক্তিং দাস্যং কৃষ্ণপদাম্বুজে।
সর্বেস্পিতং সদানন্দং সর্বসিদ্ধৌঘমীশ্বরম্ || ১০৮ ||
ধকারঃ সহবাসঞ্চ তত্তুল্যকালমেব চ।
দদাতি সার্ষ্টিং সারূপ্যং তত্ত্বজ্ঞানং হরেঃ সমম্ || ১০৯ ||”
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণম্, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে, ১৩ অঃ।
ইহার একটিও রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তি নয়। রাধ্ ধাতু আরাধনার্থে, পূজার্থে। যিনি কৃষ্ণের আরাধিকা, তিনিই রাধা বা রাধিকা। বর্তমান ব্রহ্মবৈবর্তে এ ব্যুৎপত্তি কোথাও নাই। যিনি এই রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তি গোপন করিয়া কতকগুলা অবৈয়াকরণিক কল কৌশলের দ্বারা ভ্রান্তি জন্মাইবার চেষ্টা করিয়াছেন, এবং ভ্রান্তির প্রতিপোষণার্থ মিথ্যা করিয়া সামবেদের দোহাই দিয়াছেন,* তিনি কখনও ‘রাধা’ শব্দের সৃষ্টিকারক নহেন। যিনি রাধা শব্দের প্রকৃত ব্যুৎপত্তির অনুযায়িক হইয়া রাধারূপক রচনা করেন নাই, তিনি কখনও রাধার সৃষ্টিকর্তা নহেন। সেই জন্য বিবেচনা করি যে, আদিম ব্রহ্মবৈবর্তেই রাধার প্রথম সৃষ্টি। এবং সেখানে রাধা কৃষ্ণারাধিকা আদর্শরূপিণী গোপী ছিলেন, সন্দেহ নাই।
রাধা শব্দের আর একটি অর্থ আছে—বিশাখানক্ষত্রের# একটি নাম রাধা। কৃত্তিকা হইতে বিশাখা চতুর্দশ নক্ষত্র। পূর্বে কৃত্তিকা হইতে বৎসর গণনা হইত। কৃত্তিকা হইতে রাশি গণনা করিলে বিশাখা ঠিক মাঝে পড়ে। অতএব রাসমণ্ডলের মধ্যবর্তিনী হউন বা না হউন, রাধা রাশিমণ্ডলের বা রাসমণ্ডলের মধ্যবর্তী বটেন। এই ‘রাসমণ্ডলমধ্যবর্তিনী’ রাধার সঙ্গে ‘রাসমণ্ডলে রাধার কোন সম্বন্ধ আছে কি না, তাহা আসল ব্রহ্মবৈবর্তের অভাবে স্থির করা অসাধ্য।
* রাধাশব্দস্য ব্যুৎপত্তিঃ সামবেদ নিরূপিতা || ১৩ অঃ, ১৫৩।
# রাধা বিশাখা পুষ্যে তু সিধ্যতিযৌ শ্রবিষ্ঠয়া-অমরকোষ।
# রাধা বিশাখা পুষ্যে তু সিধ্যতিযৌ শ্রবিষ্ঠয়া-অমরকোষ।