“অনন্তর গোপীগণ দেখিল, বিকশিতমুখপঙ্কজ ত্রৈলোক্যের রক্ষাকর্তা অক্লিষ্টকর্মা কৃষ্ণ আসিলেন। কেহ গোবিন্দকে আগত দেখিয়া অত্যন্ত হর্ষিত হইয়া কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলিতে লাগিল, আর কিছুই বলিতে পারিল না। কোন গোপী ললাটফলকে ভ্রূভঙ্গ করিয়া, হরিকে দেখিয়া, তাঁহারা মুখপঙ্কজ নেত্রভৃঙ্গদ্বয়ের দ্বারা পান করিতে লাগিল। কেহ গোবিন্দকে দেখিয়া নিমীলিত লোচনে যোগারূঢ়ার ন্যায় শোভিত হইয়া তাঁহার রূপ ধ্যান করিতে লাগিল। অনন্তর মাধব তাহাদিগকে অনুনয়নীয় বিবেচনায় কাহাকে বা প্রিয়ালাপের দ্বারা, কাহাকে বা ভ্রূভঙ্গবীক্ষণের দ্বারা কাহাকে বা করস্পর্শের দ্বারা সান্ত্বনা করিলেন। পরে উদারচরিত হরি প্রসন্নচিত্তা গোপীদিগের সহিত সাদরে রাসমণ্ডলমধ্যে ক্রীড়া করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহারা কৃষ্ণের পার্শ্ব ছাড়ে না, এক স্থানে স্থির থাকে, এজন্য সেই গোপীদিগের সহিত রাসমণ্ডলবন্ধও হইল না। পরে একে একে গোপীদিগকে হস্তের দ্বারা গ্রহণ করিলে তাহারা তাঁহার করস্পর্শে নিমীলিতচক্ষু হইলে কৃষ্ণ রাসমণ্ডলী প্রস্তুত করিলেন। অতঃপর গোপীদিগের চঞ্চলবলয়শব্দিত এবং গোপীগণগীত শরৎকাব্যগানের দ্বারা অনুযাত রাসক্রীড়ায় তিনি প্রবৃত্ত হইলেন। কৃষ্ণ শরচ্চন্দ্র ও কৌমুদী ও কুমুদ সম্বন্ধীয় গান করিলেন। গোপীগণ পুনঃ পুনঃ এক কৃষ্ণনামই গায়িতে লাগিল। এক গোপী নর্তনজনিত শ্রমে শ্রান্ত হইয়া চঞ্চলবলয়ধ্বনিবিশিষ্ট বাহুলতা মধুসূদনের স্কন্ধে স্থাপিত করিল। কপটতায় নিপুণা কোন গোপী কৃষ্ণগীতের স্তুতিচ্ছলে বাহুদ্বারা তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া মধুসূদনকে চুম্বিত করিল। কৃষ্ণের ভুজদ্বয় কোন গোপীর কপোলসংশ্লেষপ্রাপ্ত হইয়া পুলকোদ্গমরূপ শস্যোৎপাদনের জন্য স্বেদাম্বূমেঘত্ব প্রাপ্ত হইল। তরতর ধ্বনিতে কৃষ্ণ যাবৎকাল রাসগীত গায়িতে লাগিলেন, তাবৎকাল গোপীগণ ‘সাধু কৃষ্ণ, সাধু কৃষ্ণ’ বলিয়া দ্বিগুণ গায়িল। কৃষ্ণ গেলে তাহারা গমন করিতে লাগিল, কৃষ্ণ আবর্তন করিলে তাহারা সম্মুখে আসিতে লাগিল, এইরূপ প্রতিলোম অনুলোম গতির দ্বারা গোপাঙ্গনাগণ হরিকে ভজনা করিল। মধুসূদন গোপীদিগের সহিত সেইখানে ক্রীড়া করিলেন। তাহারা তাঁহাকে বিনা, ক্ষণমাত্রকে কোটি বৎসর মনে করিতে লাগিল। ক্রীড়ানুরাগিণী গোপাঙ্গনাগণ পতির দ্বারা, পিতার দ্বারা, ভ্রাতার দ্বারা নিবারিত হইয়াও রাত্রিকালে কৃষ্ণের সহিত ক্রীড়া করিল। শত্রুধ্বংসকারী অমেয়াত্মা মধুসূদনও আপনাকে কিশোরবয়স্ক জানিয়া, রাত্রে তাহাদিগের সহিত ক্রীড়া করিলেন।”

এই অনুবাদ সম্বন্ধে একটি কথা বক্তব্য এই যে, “রম্”-ধাতুনিষ্পন্ন শব্দের অর্থে আমি ক্রীড়ার্থে “রম” ধাতু বুঝিয়াছি; যথা, “রতিপ্রিয়া” অর্থে আমি ‘ক্রিড়ানুরাগিণী’ বুঝিয়াছি। আদৌ “রম্” ধাতু ক্রীড়ার্থেই ব্যবহৃত। উহার যে অর্থান্তর আছে, তাহা ক্রীড়ার্থ হইতেই পশ্চাৎ নিষ্পন্ন হইয়াছে। ‘রতি’ ও ‘রতিপ্রিয়’ শব্দ এই অর্থে যে কৃষ্ণলীলায় সচরাচর ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তাহার অনেক উদাহরণ আছে। পাঠক হরিবংশের সপ্তষষ্টিতম পুস্তকান্তরে অষ্টষষ্টিতম অধ্যায় এইরূপ প্রয়োগ দেখিবেন।* তথায় ক্রীড়াশীল গোপালগণকে ‘রতিপ্রিয়’ গোপাল বলা হইয়াছে। আর এই অর্থই এখানে সঙ্গত, কেন না, ‘রাস’ একটি ক্রীড়াবিশেষ। অদ্যাপি ভারতবর্ষের কোন কোন স্থানে ঐরূপ ক্রীড়া বা নৃত্য প্রচলিত আছে। রাসের অর্থ কি, তাহা শ্রীধর স্বামী বুঝাইয়াছেন। তিনি বলেন—

“অন্যোন্যব্যতিষক্তহস্তানাং স্ত্রীপুংসাং গায়তাং মণ্ডলীরূপেণ ভ্রমতাং নৃত্যবিনোদা রাসো নাম।”

অর্থাৎ স্ত্রীপুরুষে পরস্পরের হাত ধরিয়া গায়িতে গায়িতে এবং মণ্ডলীরূপে ভ্রমণ করিতে করিতে যে নৃত্য করে, তাহার নাম রাস। বালকবালিকায় এরূপ নৃত্য করে আমরা দেখিয়াছি, এবং যাহারা বাল্য অতিক্রম করিয়াছে, তাহারাও দেশবিশেষে এরূপ নৃত্য করে শুনিয়াছি। ইহাতে আদিরসের নামগন্ধও নাই।

                                    *“স তত্র বয়সা তুল্যৈর্বৎসপালৈঃ সহানঘঃ।
                                         রেমে বৈ দিবসং কৃষ্ণঃ পুরা স্বর্গগতো যথা ||
                                 তং ক্রীড়মানং গোপালাঃ কৃষ্ণং ভাণ্ডীরবাসিনম্।
                                 রময়ন্তি স্ম বহবো বন্যৈঃ ক্রীড়নকৈস্তদা ||
                                 অন্যে স্ম পরিগায়ন্তি গোপামূদিতমানসাঃ।
                                 গোপালাঃ কৃষ্ণমেবান্যে গায়ন্তি স্ম রতিপ্রিয়া ||”
  এই তিন শ্লোকে “রম্” ধাতু হইতে নিষ্পন্ন শব্দ তিন বার ব্যবহৃত হইয়াছে। যথা “রেমে”, “রময়ন্তি”, “রতিপ্রিয়া”; তিন বারই ক্রীড়ার্থে, অর্থান্তর কোন মতেই ঘটান যায় না। কেন না, গোপালদিগের কথা হইতেছে।