এরূপ কার্যের একটা নিগূঢ় তাৎপর্যও দেখা যায়। যেমন বুঝিয়াছি, তেমনই বুঝাইতেছি।

এই জগতের একই ঈশ্বর। ঈশ্বর ভিন্ন দেবতা নাই। ইন্দ্র বলিয়া কোন দেবতা নাই। ইন্দ্ ধাতু বর্ষণে, তাহার পর রক্ প্রত্যয় করিলে ইন্দ্র শব্দ পাওয়া যায়। অর্থ হইল যিনি বর্ষণ করেন। বর্ষণ করে কে? যিনি সর্বকর্তা, সর্বত্র বিধাতা, তিনিই বৃষ্টি করেন,—বৃষ্টির জন্য একজন পৃথক্ বিধাতা কল্পনা করা বা বিশ্বাস করা যায় না। তবে ইন্দ্রের জন্য যজ্ঞ বা সাধারণ যজ্ঞে ইন্দ্রের ভাগ প্রচলিত ছিল বটে। এরূপ ইন্দ্রপূজার একটা অর্থও আছে। ঈশ্বর অনন্ত প্রকৃতি, তাঁহার গুণ ভাগ প্রচলিত ছিল বটে। এরূপ ইন্দ্রপূজার একটা অর্থও আছে। ঈশ্বর অনন্ত প্রকৃতি, তাঁহার গুণ সকল অনন্ত, কার্য অনন্ত, শক্তি সকলও সংখ্যায় অনন্ত। এরূপ অনন্তের উপাসনা কি প্রকারে করিব? অনন্তের ধ্যান হয় কি? যাহাদের হয় না, তাহারা তাঁহার ভিন্ন ভিন্ন শক্তির পৃথক্ পৃথক্ উপাসনা করে। এরূপ শক্তি সকলের বিকাশস্থল জড়জগতে বড় জাজ্বল্যমান। সকল জড়পদার্থে তাঁহার শক্তির পরিচয় পাই। তৎ-সাহায্যে অনন্তের ধ্যান সুসাধ্য হয়। এই জন্য প্রাচীন আর্যগণ তাঁহার জগৎপ্রসবিতৃত্ব স্মরণ করিয়া সূর্যে, তাঁহার সর্বাবরকতা স্মরণ করিয়া বরুণে, তাঁহার সর্বতেজের আধারভূতি স্মরণ করিয়া অগ্নিতে, তাঁহাকে জগৎপ্রাণ স্মরণ করিয়া বায়ুতে, এবং তদ্রূপে অন্যান্য জড়পদার্থে তাঁহার আরাধনা করিতেন।* ইন্দ্রে এইরূপ তাঁহার বর্ষণকারিণী শক্তির উপাসনা করিতেন। কালে, লোকে উপাসনার অর্থ ভুলিয়া গেল, কিন্তু উপাসনার আকারটা বলবান্ রহিল। কালে এইরূপই ঘটিয়া থাকে; ব্রাহ্মণের ত্রিসন্ধ্যা সম্বন্ধে তাহাই ঘটিয়াছে; ভগবদ্‌গীতায় এবং মহাভারতের অন্যত্র দেখিব যে, কৃষ্ণ ধর্মের এই মৃতদেহের সৎকারে প্রবৃত্ত—তৎপরিবর্তে অতি উচ্চ ঈশ্বরোপাসনাতে লোককে প্রবৃত্ত করিতে যত্নবান্। যাহা পরিণত বয়সে প্রচারিত করিয়াছিলেন, এই গিরিযজ্ঞে তাহার প্রবর্তনায় তাঁহার প্রথম উদ্যম। জগদীশ্বর সর্বভূতে আছেন; মেঘেও যেমন আছেন, পর্বতে ও গোবৎসেও সেইরূপ আছেন। যদি মেঘের বা আকাশের পূজা করিলে তাঁহার পূজা করা হয়, তবে পর্বত বা গোগণের পূজা করিলেও তাঁহারই পূজা করা হইবে। বরং আকাশাদি জড়পদার্থের পূজা অপেক্ষা দরিদ্রদিগের এবং গোবৎসের সপরিতোষ ভোজন করান অধিকতর ধর্মানুমত। গিরিযজ্ঞের তাৎপর্যটা এইরূপ বুঝি।

* যখন আমি প্রথম “প্রচার” নামক পত্রে এই মত প্রকাশিত করি, তখন অনেকে কথা বলিয়াছিলেন। অনেকে ভাবিয়াছিলেন, আমি একটা নূতন মত প্রচার করিতেছি। তাঁহারা জানেন না যে, এ আমার মত নহে, স্বয়ং নিরুক্তকার যাস্কের মত। আমি যাস্কের বাক্য নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি-

“মাহাত্ম্যাদ্ দেবতায়া এক আত্মা বহুধা স্তৃয়তে। একস্যাত্মনোহন্যে দেবাঃ প্রত্যঙ্গানি ভবন্তি। * * আত্মা এব এষাং রথো ভবতি, আত্মা অশ্বাঃ, আয়ুধম্, আত্মা ইষবঃ, আত্মা সর্বদেবস্য।”