কৃষ্ণচরিত্র - দ্বিতীয় খণ্ড
উপন্যাসটি এই। যমুনার এক হ্রদে বা আবর্তে কালিয় নামে এক বিষধর সর্প সপরিবারে বাস করিত। তাহার বহু ফণা। বিষ্ণুপুরাণের মতে তিনটি,# হরিবংশের মতে পাঁচটি, ভাগবতে সহস্র। তাহার অনেক স্ত্রী পুত্র পৌত্র ছিল। তাহাদিগের বিষে সেই আবর্তের জল এমন বিষময় হইয়া উঠিয়াছিল যে, তজ্জন্য নিকটে কেহ তিষ্ঠিতে পারিত না। অনেক ব্রজবালক ও গোবৎস সেই জল পান করিয়া প্রাণ হারাইত। সেই বিষের জ্বালায়, তীরে কোন তৃণলতা বৃক্ষাদিও বাঁচিত না। পক্ষিগণও সেই আবর্তের উপর দিয়া উড়িয়া গেলে বিষে জর্জরিত হইয়া জলমধ্যে পতিত হইত। এই মহাসর্পের দমন করিযা বৃন্দাবনস্থ জীবগণের রক্ষাবিধান, শ্রীকৃষ্ণের অভিপ্রেত হইল। তিনি উল্লম্ফনপূর্বক হ্রদমধ্যে নিপতিত হইলেন। কালিয় তাঁহাকে আক্রমণ করিল। তাহার ফণার উপর আরোহণ করিয়া বংশীধর গোপবালক নৃত্য করিতে লাগিলেন। ভুজঙ্গ সেই নৃত্যে নিপীড়িত হইয়া রুধিরবমনপূর্বক মুমূর্ষু হইল।
তখন তাহার বনিতাগণ কৃষ্ণকে মনুষ্যভাষায় স্তব করিতে লাগিল। ভাগবতকার তাহাদিগের মুখে যে স্তব বসাইয়াছেন, তাহা পাঠ করিয়া ভুজঙ্গমাঙ্গনাগণকে দর্শনশাস্ত্রে সুপণ্ডিতা বলিয়া বোধ হয়। বিষ্ণুপুরাণে তাহাদিগের মুখনির্গত স্তব বড় মধুর; পড়িয়া বোধ হয়, মনুষ্যপত্নীগণকে কেহ গরলোদ্গারিণী মনে করেন করুন, নাগপত্নীগণ সুধাবর্ষিণী বটে। শেষে কালিয় নিজেও কৃষ্ণস্তুতি আরম্ভ করিল। শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হইয়া কালিয়কে পরিত্যাগ করিয়া যমুনা পরিত্যাগপূর্বক সমুদ্রে গিয়া বাস করিতে তাহাকে আদেশ করিলেন। কালিয় সপরিবারে পলাইল। যমুনা প্রসন্নসলিলা হইলেন।
এই গেল উপন্যাস। ইহার ভিতর যে রূপক আছে, তাহা এই। এই কলবাহিনী কৃষ্ণসলিলা কালিন্দী অন্ধকারময়ী ঘোরনাদিনী কালস্রোতস্বতী। ইহার অতি ভয়ঙ্কর আবর্ত আছে। আমরা যে সকলকে দুঃসময় বা বিপৎকাল মনে করি, তাহাই কালস্রোতের আবর্ত। অতি ভীষণ বিষময় মনুষ্যশত্রু সকল এখানে লুক্কায়িত ভাবে বাস করে। ভুজঙ্গের ন্যায় তাহাদের নিভৃত বাস, ভুজঙ্গের ন্যায় তাহাদের কুটিল গতি, এবং ভুজঙ্গের ন্যায় অমোঘ বিষ। আধিভৌতিক, আধ্যাত্মিক, এবং আধিদৈবিক, এই ত্রিবিধবিশেষে এই ভুজঙ্গের তিন ফণা। আর যদি মনে করা যায় যে, আমাদের ইন্দ্রিয়রতিই সকল অনর্থের মূল, তাহা হইলে, পঞ্চেন্দ্রিয়ভেদে ইহার পাঁচটি ফণা, এবং আমাদের অমঙ্গলের অসংখ্য কারণ আছে, ইহা ভাবিলে, ইহার সহস্র ফণা। আমরা ঘোর বিপদাবর্তে এই ভুজঙ্গমের বশীভূত হইলে জগদীশ্বরের পাদপদ্ম ব্যতীত, আমাদের উদ্ধারের উপায়ান্তর নাই। কৃপাপরবশ হইলে তিনি এই বিষধরকে পদদলিত করিয়া মনোহর মূর্তিবিকাশপূর্বক অভয়বংশী বাদন করেন, শুনিতে পাইলে জীব আশান্বিত হইয়া সুখে সংসারযাত্রা নির্বাহ করে। করালনাদিনি কালতরঙ্গিণী প্রসন্নসলিলা হয়। এই কৃষ্ণসলিলা ভীমনাদিনী কালস্রোতস্বতীর আবর্তমধ্যে অমঙ্গলভুজঙ্গমের মস্তকারূঢ় এই অভয়বংশীধর মূর্তি, পুরাণকারের অপূর্ব সৃষ্টি! যে গড়িয়া পূজা করিবে কে তাহাকে পৌত্তলিক বলিয়া উপহাস করিতে সাহস করিবে?
আমরা ধেনুকাসুর (গর্দভ) এবং প্রলম্বাসুরের বধবৃত্তান্ত কিছু বলিব না, কেন না, উহা বলরামকৃত—কৃষ্ণকৃত নহে। বস্ত্রহরণ সম্বন্ধে যাহা বক্তব্য, তাহা আমরা অন্য পরিচ্ছেদে বলিব, এখন কেবল গিরিযজ্ঞবৃত্তান্ত বলিয়া এ পরিচ্ছেদের উপসংহার করিব।
# “মধ্যমং ফণং” ইহাতে তিনটি বুঝায়।