হ। আ–এমন কি–

নি। এমন কিছু নয়, ফাঁসি!

হ। তা–না–এই–তা কি জান–

নি। দেবী তোমার কোন অনিষ্ট করে নাই, বরং ভারী উপকার করিয়াছিল–যখন তোমার জাতি যায়, প্রাণ যায়, তখন তোমায় পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিয়া, তোমায় রক্ষা করিয়াছিল। তার প্রত্যুপকারে তুমি তাহাকে ফাঁসি দিবার চেষ্টায় ছিলে। তোমার যোগ্য কি দণ্ড বল দেখি?

হরবল্লভ চুপ করিয়া রহিল।

নিশি বলিতে লাগিল, “তাই বলিতেছিলাম, এই বেলা ঘুমাইয়া লও–আর রাত্রের মুখ দেখিবে না। নৌকা কোথায় যাইতেছে বল দেখি?”

হরবল্লভের কথা কহিবার শক্তি নাই।

নিশি বলিতে লাগিল, “ডাকিনীর শ্মশান বলিয়া প্রকাণ্ড শ্মশান আছে। আমরা যাদের প্রাণে মারি, তাদের সেইখানে লইয়া গিয়া মারি। বজরা এখন সেইখানে যাইতেছে। সেইখানে পৌঁছিলে সাহেব ফাঁসি যাইবে, রাণীজির হুকুম হইয়া গিয়াছে। আর তোমায় কি হুকুম করিয়াছে, জান?”

হরবল্লভ কাঁদিতে লাগিল–জোড়হাত করিয়া বলিল, “আমায় রক্ষা কর।”

নিশি বলিল, “তোমায় রক্ষা করিবে, এমন পাষণ্ড পামর কে আছে? তোমায় শূলে দিবার হুকুম হইয়াছে।”

হরবল্লভ ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল। ঝড়ের শব্দ বড় প্রবল; সে কান্নার শব্দ ব্রজেশ্বর শুনিতে পাইল না–দেবীও না। সাহেব শুনিল। সাহেব কথাগুলা শুনিতে পায় নাই–কান্না শুনিতে পাইল। সাহেব ধমকাইল, “রোও মৎ-উল্লুক মর্নাি এক রোজ আল্‌বৎ হ্যায়।”

সে কথা কাণে না তুলিয়া নিশির কাছে জোড়হাত করিয়া বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাঁদিতে লাগিল। বলিল, হাঁ গা! আমায় কি কেউ রক্ষা করিতে পারে না গা?”

নি। তোমার মত নরাধমকে বাঁচাইয়া পাতকগ্রস্ত হইবে? আমাদের রাণী দয়ময়ী, কিন্তু তোমার জন্য কেহই তাঁর কাছে দয়ার ভিক্ষা করিব না।

হ। আমি লক্ষ টাকা দিব।

নি। মুখে আনিতে লজ্জা করে না? পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য এই কৃতঘ্নের কাজ করিয়াছ–আবার লক্ষ টাকা হাঁক?

হ। আমাকে যা বলিবে, তাই করিব।

নি। তোমার মত লোকের দ্বারা কোন্ কাজ হয় যে, তুমি, যা বলিব, তাই করিবে?

হ। অতি ক্ষুদ্রের দ্বারাও উপকার হয়–ওগো, কি করিতে হইবে বল, আমি প্রাণপণ করিয়া করিব–আমায় বাঁচাও।

নি। (ভাবিতে ভাবিতে) তোমার দ্বারাও আমার একটা উপকার হইলে হইতে পারে–তা তোমার মত লোকের দ্বারা সে উপকার না হওয়াই ভাল।

হ। তোমার কাছে জোড়হাত করিতেছি–তোমার হাত ধরিতেছি–

হরবল্লভ বিহ্বল–নিশি ঠাকুরাণীর বাঁউড়ী-পরা গোলগাল হাতখানি প্রায় ধরিয়া ফেলিয়াছিল আর কি! চতুরা নিশি আগে হাত সরাইয়া লইল–বলিল, “সাবধান! ও হাত শ্রীকৃষ্ণের গৃহীত। কিন্তু তোমার হাতে-পায়ে ধরিয়া কাজ নাই–তুমি যদি এতই কাতর হইয়াছ, তবে তুমি যাতে রক্ষা পাও, আমি তা করিতে রাজি হইতেছি। কিন্তু তোমায় যা বলিব, তা যে তুমি করিবে, এ বিশ্বাস হয় না। তুমি জুয়োচোর, কৃতঘ্ন, পামর, গোইন্দাগিরি কর–তোমার কথায় বিশ্বাস কি?”

হ। যে দিব্য বল, সেই দিব্য করিতেছি।