কমলাকান্ত-কমলাকান্তের পত্র
তখন ধূল্যবলুষ্ঠিত শরীরে দ্বিরেফরাজের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিলাম “হে দ্বিরেফসত্তম! কোন্ অপরাধে দুঃখী ব্রাহ্মণ তোমার নিকট অপরাধী যে, তুমি তাহার লেখা পড়ার ব্যাঘাত করিতে আসিয়াছ? দেখ, আমি এই বঙ্গদর্শনে পত্র লিখিতে বসিয়াছি-পত্র লিখিলে আফিঙ্গ আসিবে-তুমি কেন ঘ্যানঘ্যান্ করিয়া তাহার বিঘ্ন কর?” আমি প্রাতে একখানি বাঙ্গালা নাটক পড়িতেছিলাম-তখন অকস্মাৎ সেই নাটকীয় রাগগ্রস্ত হইয়া বলিতে লাগিলাম- “হে ভৃঙ্গ! হে অনঙ্গরঙ্গতরঙ্গবিক্ষে- পকারিন্! হে দুর্দ্দান্ত পাষণ্ডভণ্ডচিত্তলণ্ডভণ্ড-করিন! হে উদ্যানবিহারিন্-কেন তুমি ঘ্যানঘ্যান্ করিতেছ? হে ভৃঙ্গ! হে দ্বিরেফ! হে ষটপদ! হে অলে! হে ভ্রমর! হে ভোমরা! হে ভোঁ ভোঁ-
ভ্রমর ঝুপ করিয়া আসিয়া সামনে বসিল। তখন গুণ্ গুণ্ করিয়া গলা দুরস্ত করিয়া বলিতে লাগিল–আমি অহিফেনপ্রসাদে সকলেরই কথা বুঝিতে পারি–আমি স্থিরচিত্তে শুনিতে লাগিলাম।
ভৃঙ্গরাজ বলিতে লাগিলেন, “হে বিপ্র! আমারি উপর এত চোট কেন? আমি কি একাই ঘ্যানঘেনে! তোমার এ বঙ্গভূমে জন্মগ্রহণ করিয়া ঘ্যানঘ্যান্ করিব না ত কি করিব? বাঙ্গালী হইয়া কে ঘ্যানঘ্যানানি ছাড়া? কোন্ বাঙ্গালির ঘ্যানঘ্যানানি ছাড়া অন্য ব্যবসা আছে। তোমাদের মধ্যে যিনি রাজা মহারাজা কি এমনি একটা কিছু মাথায় পাগড়ি ঙ হইলেন, তিনি গিয়া বেল্-ভিডিয়রে ঘ্যানঘ্যান্ আরম্ভ করিলেন। যিনি হইবেন উমেদ রাখেন, তিনি গিয়া রাত্রিদিবা রাজদ্বারে ঘ্যানঘ্যান্ করেন। যিনি কেবল একটি চাকরির উমেদওয়ার-তাঁর ঘ্যানঘ্যানানির ত আর অন্ত নাই। বাঙ্গালি বাবু যিনিই দুই চারিটা ইংরেজি বোল শিখিয়াছেন, তিনি অমনি উমেদওয়াররূপে পরিণত হইয়া, দরখাস্ত বা টিকিট হাতে দ্বারে দ্বারে ঘ্যানঘ্যান্-ডাঁশমাছির মত খাবার সময়ে, শোবার সময়ে, বসবার সময়ে, দাঁড়াবার সময়ে, দিনে, রাত্রে, প্রাহ্নে, অপরাহ্নে, মধ্যাহ্নে সায়াহ্নে-ঘ্যান্ ঘ্যান্ ঘ্যান্! যিনি উমেদওয়ারি স্বাধীন হইয়া উকীল হইলেন, তিনি আবার সনদী ঘ্যানঘেনে। সত্যমিথ্যার সাগরসঙ্গমে প্রাতঃস্নান করিয়া উঠিয়া, যেখানে দেখেন, কাঠগড়ার ভিতর বিড়ে মাথায় সরকারি জুজু বসিয়া আছে-বড় জজ, ছোট জজ, সবজজ, ডিপুটি, মুন্সেফ-সেইখানে গিয়া সেই পেশাদার ঘ্যানঘ্যানে, ঘ্যানঘ্যানানির ফোয়ারা খুলিয়া দেন। কেহ বা মনে করেন, ঘ্যানঘ্যানানির চোটে দেশোদ্ধার করিবেন-সভাতলে ছেলে বুড়ো জমা করিয়া ঘ্যানঘ্যান্ করিতে থাকেন। কোন্ দেশে বৃষ্টি হয় নাই-এসো বাপু ঘ্যানঘ্যান্ করি; বড় চাকরি পাই না-এসো বাপু ঘ্যানঘ্যান্ করি-রমাকান্তের মা মরিয়াছে-এসো বাপু স্মরণার্থ ঘ্যানঘ্যান্ করি। কাহারও বা তাতেও মন উঠে না-তাঁরা কাগজ কলম লইয়া, হপ্তায় হপ্তায়, মাসে মাসে, দিন দিন ঘ্যানঘ্যান্ করেন; আর তুমি যে বাপু আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে এত রাগ করিতেছ, তুমিও ও কি করিতে বসিয়াছ? বঙ্গদর্শন-সম্পাদকের কাছে কিছু আফিঙ্গের যোগাড় করিবে বলিয়া ঘ্যানঘ্যান্ করিতে বসিয়াছ? আমার চোঁ বোঁই কি এত কটু?
“তোমায় সত্য বলিতেছি, কমলাকান্ত! তোমাদের জাতির ঘ্যানঘ্যানানি আর ভাল লাগে না। দেখ আমি যে ক্ষুদ্র পতঙ্গ, আমিও শুধু ঘ্যানঘ্যান্ করি না-মধু সংগ্রহ করি, আর হুল ফুটাই। তোমরা না জান শুধু মধু সংগ্রহ করিতে না জান হুল ফুটাইতে-কেবল ঘ্যানঘ্যান্ পার। একটা কাজের সঙ্গে খোঁজ নাই-কেবল কাঁদুনে মেয়ের মত দিবারাত্রি ঘ্যানঘ্যান্। একটু বকাবকি লেখালেখি কম করিয়া কিছু কাজে মন দাও-তোমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইবে। মধু করিতে শেখ-হুল ফুটাইতে শেখ। তোমাদের রসনা অপেক্ষা আমাদের হুল শ্রেষ্ঠ-বাক্যবাণে মানুষ মরে না; আমাদের হুলের ভয়ে জীবলোক সদা সশঙ্কিত! স্বর্গে ইন্দ্রের বজ্র, মর্ত্ত্যে ইংরেজদের কামান, আকাশমার্গে আমাদের হুল! সে যাক, মধু কর; কাজে মন দাও। নিতান্ত যদি দেখ, রসনাকণ্ডুয়ন রোগ জন্য কাজে মন যায় না-জিবে কাষ্ঠকি দিয়া ঘা কর-অগত্যা কাজে মন যাইতে পারে। আর শুধু ঘ্যানঘ্যান্ ভাল লাগে না।”
এই বলিয়া ভ্রমররাজ ভোঁ করিয়া উড়িয়া গেল।
আমি ভাবিলাম যে, এই ভ্রমর অবশ্য বিশেষ বিজ্ঞ পতঙ্গ। শুনা আছে, মনুষ্যের পদবৃদ্ধি হইলেই সে বিজ্ঞ বলিয়া গণ্য হয়। এই জন্য দ্বিপদ মনুষ্য হইতে চতুষ্পদ পশু-পক্ষান্তরে যে সকল মনুষ্যের পদবৃদ্ধি হইয়াছে-তাহারা অধিক বিজ্ঞ বলিয়া গণ্য। এই ষট্পদের-একখানি না, দুখানি না-ছয় ছয়খানি পা! অবশ্য এ ব্যক্তি বিশেষ বিজ্ঞ হইবে-ইহার অসামান্য পদবৃদ্ধি দেখা যায়। এই বিজ্ঞ পতঙ্গের পরামর্শ অবহেলন করি কি প্রকারে? অতএব আপাততঃ ঘ্যানঘ্যানানি বন্ধ করিলাম-কিন্তু মধুসংগ্রহের আশাটা রহিল। বঙ্গদর্শন পুষ্প হইতে অহিফেন মধু সংগ্রহ হইবে এই ভরসায় প্রাণ ধারণ করে-
আপনার আজ্ঞাবহ
শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী।