জগদ্বিখ্যাত Le Contrat Social নামক গ্রন্থে রূসো এই সকল মতের কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করিয়াছিলেন। সভ্যাবস্থার তাদৃশ দোষকীর্তনে ক্ষান্ত হইয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন যে অসভ্যাবস্থায় যেখানে সহজ জ্ঞানে ধর্ম নির্ণীত হয়, সভ্যাবস্থায় তৎপরিবর্তে ন্যায়ানুভাবকতা সন্নিবেশিত হয়। সম্পত্তি সম্বন্ধে তিনি প্রথমাধিকারীকে অধিকারী বলিয়া স্বীকার করেন। কিন্তু অবস্থাবিশেষে মাত্র—প্রথম, যদি ভূমি পূর্বে অধিকৃত হইয়া থাকে; দ্বিতীয়, অধিকারী যদি আত্মভরণপোষণের উপযোগী মাত্র ভূমি অধিকার করে, তাহার অধিক না লয়, তৃতীয় যদি নামমাত্র দখল না লইয়া, কর্ষণাদির দ্বারা দখল লওয়া হয়, তবে অধিকৃত ভূমি অধিকারীর সম্পত্তি। Le Contrat Social গ্রন্থের স্থূলোদ্দেশ্য এই যে, সমাজ সমাজভুক্তদিগের সম্মতিসৃষ্ট। যেমন পাঁচ জন ব্যবসাদার মিলিয়া, পরস্পরে কতকগুলি নিয়মের দ্বারা বদ্ধ হইয়া, একটি জয়েণ্ট স্টক কোম্পানী সৃষ্ট করেন, রূসোর মতে সমাজ, রাজ্য, শাসন, এ সকল সেইরূপে লোকের মঙ্গলার্থ লোকের দ্বারা সৃষ্ট। এ কথার ফল অতি গুরুতর। তোমায় আমায় চুক্তি হইয়াছে যে, তুমি আমার জমী চষিয়া দিবে, আমি তোমাকে খাইতে পরিতে দিব, এবং গৃহে স্থান দিব। তুমি যে দিন আমার ভূমিকর্ষণ বন্ধ করিলে, সেই দিন আমি তোমার গলদেশে হস্তার্পণ করিয়া গৃহ হইতে বাহির করিয়া দিলাম এবং গ্রাসাচ্ছাদন বন্ধ করিলাম। এই কার্য ন্যায়সঙ্গত হইল। তেমনি যদি রাজা প্রজার সম্বন্ধ কেবল চুক্তিমাত্র হয়, তবে প্রজা অত্যাচারী রাজাকে বলিতে পারে, “তুমি চুক্তি ভঙ্গ করিয়াছ। প্রজার মঙ্গল করিবে এই অঙ্গীকারে তুমি রাজা; তোমার কার্য আমাদের মঙ্গল করা, আমাদের কার্য তোমাকে করদান ও তোমার আজ্ঞাপালন। তুমি এখন আর আমাদের মঙ্গল কর না, অতএব আমরাও তোমাকে কর দিব না বা তোমার আজ্ঞাপালন করিব না। তুমি রত্নসিংহাসন হইতে অবতরণ কর।”

অতএব যে দিন Le Contrat Social প্রচারিত হইল, সেই দিন ফরাসী রাজার হস্তের রাজদণ্ড ভগ্ন হইল। Le Contrat Social গ্রন্থের চরম ফল ষোড়শ লুইর সিংহাসনচ্যুতি, এবং প্রাণদণ্ড। ফরাসীবিপ্লবে যাহা কিছু ঘটিয়াছিল, তাহার মূল এই গ্রন্থে। সেই যজ্ঞে বেদমন্ত্র, এই গ্রন্থোক্ত বাণী।

সেই ফরাসীবিপ্লবে, রাজা গেল, রাজকুল গেল, রাজপদ গেল, রাজনাম লুপ্ত হইল; সম্ভ্রান্ত লোকের সম্প্রদায় লুপ্ত হইল; পুরাতন খ্রীষ্টীয় ধর্ম গেল, ধর্মযাজকসম্প্রদায় গেল; মাস, বার প্রভৃতির নাম পর্যন্ত লুপ্ত হইল—অনন্তপ্রবাহিত শোণিতস্রোতে সকল ধুইয়া গেল। কালে আবার সকলই হইল, কিন্তু যাহা ছিল, তাহা আর হইল না। ফ্রান্স নূতন কলেবর প্রাপ্ত হইল। ইউরোপে নূতন সভ্যতার সৃষ্টি হইল—মনুষ্যজাতির স্থায়ী মঙ্গল সিদ্ধ হইল। রূসোর ভ্রান্ত বাক্যে অনন্তকালস্থায়িনী কীর্তি সংস্থাপিতা হইল। কেন না, সেই ভ্রান্ত বাক্য সাম্যাত্মক—সেই ভ্রান্তির কায়া অর্ধেক সত্যে নির্মিত।

ফরাসীবিপ্লব শমিত হইল, তাহার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল। কিন্তু “ভূমি সাধারণের” এই কথা বলিয়া রূসো যে মহাবৃক্ষের বীজ বপন করিয়াছিলেন, তাহার নিত্য নূতন ফল ফলিতে লাগিল। অদ্যাপি তাহার ফলে ইউরোপ পরিপূর্ণ। “কম্যুনিজম্” সেই বৃক্ষের ফল! “ইণ্টারন্যাশনল” সেই বৃক্ষের ফল। এ সকলের যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় দিব।

এ দেশে এবং অন্য দেশে সচরাচর সম্পত্তি ব্যক্তিবিশেষের। আমার বাড়ী, তোমার ভূমি, তাহার বৃক্ষ। কিন্তু ইহা ভিন্ন আর কোন প্রকার সম্পত্তি হইতে পারে না, এমত নহে। ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি না হইয়া, সর্বলোকসাধারণের সম্পত্তি হইতে পারে। এই সর্বলোকপালিকা বসুন্ধরা কাহারও একার জন্য সৃষ্ট হয় নাই বা দশ পনের জন ভূম্যধিকারী জন্য সৃষ্ট হয় নাই। অতএব ভূমির উপর সকলেরই সমান অধিকার থাকা কর্তব্য। সর্ববিঘ্নবিনাশিনী বাক্‌শক্তির বলে, এই কথা রূসো পৃথিবীর মধ্য আদৃতা করাইয়াছিলেন। ক্রমে বিজ্ঞ, বিবেচক, পণ্ডিতেরা সেই ভিত্তির উপর সম্পত্তিমাত্রেরই সাধারণতা স্থাপন করিবার মত সকল প্রচার করিতে লাগিলেন।