বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড - রামধন পোদ
এই সকল ভাবিয়া চিন্তিয়া অনেকে বলেন, যতদিন না বাঙ্গালী সাধারণতঃ মাংসাহার করে, ততদিন বাঙ্গালীর বাহুতে বল হইবে না। আমরা সে কথা বলি না। মাংসের প্রয়োজন নাই, দুগ্ধ, ঘৃত, ময়দা, ডাল, ছোলা, ভাল শব্জী, ইহাই উত্তম আহার। দৃষ্টান্ত—পশ্চিমে হিন্দুস্থানী। নৈবেদ্যে বিল্বপত্রের মত ভাতের সঙ্গে ইহাদের সংস্পর্শমাত্রের পরিবর্ত্তে, অন্নের সঙ্গে ইহাদের যথোচিত সমাবেশ হইলেই বলকারক আহার হইল। বাঙ্গালী যদি ভাতের মাত্রা কমাইয়া দিয়া এই সকলের মাত্রা বাড়াইতে পারে, তবে এক পুরুষে নীরোগ, দুই তিন পুরুষে বলিষ্ঠকায় হইতে পারে।
আমি এই সকল কথা রামধন পোদকে বুঝাইতেছিলাম—কেন না, রামধন পোদের সাতগোষ্ঠী বড় রোগা। রামধন আমার কাছে হাত যোড় করিয়া বলিল, “মহাশয় যা আজ্ঞা কর্লেন, তা সবই যথার্থ—কিন্তু ঘি, ময়দা, ডাল ছোলা! বাবা, এ সকল পাব কোথায়? এমনই যে শুধু ভাতের খরচ জুটিয়ে উঠিতে পারি না।”
কথাটা দেখিলাম সত্য। আমি রামধনের ঢেঁকিশালে ঢেঁকির উপর বসিয়াছিলাম—উঠানে একটা ঘেও কুকুর পড়িয়াছিল বলিয়া আর আগু হইতে পারি নাই—সেইখান হইতেই রামধনের বংশাবলীর পরিচয় পাইতেছিলাম। রামধন একটি একটি করিয়া দেখাইল যে, তাহার চারিটি ছেলে, পাঁচটি মেয়ে; একটি ছেলে আর তিনটি মেয়ের বিবাহ দিতে বাকি আছে—পোদজেতের ছেলের বিয়েতেও কড়ি খরচা, মেয়ের বিয়েতেও বটে-তবে কম। পোদ বলিল, যে, “মহাশয় গা! একটু পরিবার ছেঁড়া নেক্ড়া জুটাইতে পারি না—আবার ঘি, ময়দা, ডাল ছোলা!” আমি বুঝিলাম, কথাটা বড় অসঙ্গত হইয়াছে। বোধ হইল, যেন প্রাঙ্গণশায়ী রুগ্ন কুকুরটিও আমার উপর রাগ করিয়া তর্জ্জন গর্জ্জন করিবার উদ্যোগী—বোধ হইল, যেন সে বলিতেছে, “একমুঠা ফেলা ভাত পাই না, আবার উনি বুট পায়ে দিয়া ঢেঁকির উপর বসিয়া ঘি ময়দার বাহানা আরম্ভ করিলেন।” একটি রোমশূন্য গৃহমার্জ্জার আমার দিকে পিছন ফিরিয়া, লেজ উঁচু করিয়া চলিয়া গেল—সেই নীরস রামধনালয়ে ঘৃত, দুগ্ধ, নবনীতের কথা শুনিয়া সে আমাকে উপহাস করিয়া গেল সন্দেহ নাই।
আমি রামধনকে বলিলাম, “চারিটি ছেলে-তিনটি মেয়ে! আবার তার উপর দুইটি পুত্রবধূ বাড়িয়াছে?” রামধন যোড় করিয়া বলিল, “আজ্ঞা হাঁ, আপনার আশীর্ব্বাদে দুইটি পুত্রবধূ হইয়াছে।”
আমি বলিলাম, “তাহাদের সন্তান সন্ততিও হইয়াছে?”
রামধন বলিল, “আজ্ঞা একটির দুইটি মেয়ে, একটির একটি ছেলে।”
আমি বলিলাম, “রামধন! শত্রুর মুখে ছাই দিয়া অনেকগুলি পরিবার বাড়িয়াছে। বহু পরিবার বলিয়া তোমার আগেই খাইবার কষ্ট ছিল, এখন আরও কষ্ট হইয়াছে বোধ হয়।”
রামধন বলিল, “এখন বড় কষ্ট হইয়াছে।”
আমি তখন রামধনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “রামধন! কেন এত পরিবার বাড়াইলে?”
রামধন কিছু বিস্মিত হইল। বলিল, “সে কি মহাশয়! আমি কি পরিবার বাড়াইলাম! বিধাতা বাড়াইয়াছেন।”
আমি বলিলাম, “গরিব বিধাতাকে অনর্থক দোষ দিও না। ছেলের বিয়ে তুমি দিয়াছ—সুতরাং তুমিই দুইটি পুত্রবধূ বাড়াইয়াছ। আর ছেলের বিয়ে দিয়াছ বলিয়াই তিনটি নাতি নাতনী বাড়াইয়াছ।”
রামধন কাতর হইয়া বলিল, “মহাশয়, আমাকে অমন করিয়া খুঁড়িবেন না, যমদণ্ডে সে দিন আমার আর একটি নাতি নষ্ট হয়েছে।”
আমি দুঃখপ্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সেটি কিসে গেল রামধন!”
রামধন কিছু উত্তর দেয় না। পীড়াপীড়ি করিয়া, কতকগুলি জেরার সওয়াল করিয়া, বাহির করিলাম যে, সেটি অনাহারে মরিয়াছে। মাতা পীড়িত হওয়ায় মাতৃস্তনে দুধ ছিল না । রামধনের গোরু মরিয়া গিয়াছিল—দুধ কিনিবার সাধ্য নাই। ছেলেটি না খাইয়া পেটের পীড়ায় ভুগিয়া* মরিয়া গিয়াছিল।
* অনাহারের একটি ফল পেটের পীড়া, ইহা সকলের জানা না থাকিতে পারে।