দিবা বলিল, “সাহেব! তোমার যিশুখ্রীষ্টের দিব্য, তুমি যদি নিরপরাধিনীকে ধরিয়া লইয়া যাও। আমি দেবী।”

সাহেব বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি তামাশা? কে দেবী চৌধুরাণী, তুমি যথার্থ বলিবে?”

রঙ্গরাজ কিছু বুঝিল না, কেবল অনুভব করিল যে, ভিতরে একটা কি কৌশল আছে। অতএব বুদ্ধি খাটাইয়া সে নিশিকে দেখাইয়া, হাতজোড় করিয়া বলিল, “হুজুর! এ-ই যথার্থ দেবী রাণী।”

তখন দেবী প্রথম কথা কহিল। বলিল, “আমার ইহাতে কথা কহা বড় দোষ। কিন্তু কি জানি, এর পর মিছা কথা ধরা পড়িলে, যদি সকলে মারা যায়, তাই বলিতেছি, এ ব্যক্তি যাহা বলিতেছে, তাহা সত্য নহে।” পরে নিশিকে দেখাইয়া বলিল, “এ দেবী নহে। যে উহাকে দেবী বলিয়া পরিচয় দিতেছে, সে রাণীজিকে মা বলে, রাণীজিকে মার মত ভক্তি করে, এই জন্য সে রাণীজিকে বাঁচাইবার জন্য অন্য ব্যক্তিকে নিশান দিতেছে।”

তখন সাহেব দেবীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দেবী তবে কে?”

দেবী বলিল, “আমি দেবী।”

দেবী এই কথা বলিলে নিশিতে, দিবাতে, রঙ্গরাজে ও দেবীতে বড় গণ্ডগোল বাধিয়া গেল। নিশি বলে, “আমি দেবী,” দিবা বলে, “আমি দেবী,” রঙ্গরাজ নিশিকে বলে, “এই দেবী,” দেবী বলে, “আমি দেবী।” বড় গোলমাল।

তখন লেফটেনান্ট সাহেব মনে করিলেন, এ ফেরেববাওজির একটা চূড়ান্ত করা উচিত। বলিলেন, “তোমাদের দুই জনের মধ্যে একজন দেবী চৌধুরাণী বটে। ওটা চাকরাণী, ওটা দেবী নহে। এই দুই জনের মধ্যে কে সে পাপিষ্ঠা, তাহা তোমরা চাতুরী করিয়া আমাকে জানিতে দিতেছ না। ইহার পর প্রমাণের দ্বারা যে দেবী চৌধুরাণী বলিয়া সাব্যস্ত হইবে, সেই ফাঁসি যাইবে। যদি প্রমাণের দ্বারা এ কথা পরিষ্কার না হয়, তবে দুই জনের ফাঁসি যাইবে।”

তখন নিশি ও দিবা দুই জনেই বলিল, “এত গোলযোগে কাজ কি? আপনার সঙ্গে কি গোইন্দা নাই? যদি গোইন্দা থাকে, তবে তাহাকে ডাকালেই ত সে বলিয়া দিতে পারিবে, –কে যথার্থ দেবী চৌধুরাণী।”

হরবল্লভকে বজরায় আনিবে, দেবীর এই প্রধান উদ্দেশ্য। হরবল্লভের রক্ষার ব্যবস্থা না করিয়া, দেবী আত্মরক্ষার উপায় করিবে না, ইহা স্থির। তাঁহাকে বজরায় না আনিতে পারিলে হরবল্লভের রক্ষার নিশ্চয়তা হয় না।

সাহেব মনে করিলেন, “এ পরামর্শ মন্দ নহে।” তখন তাঁহার সঙ্গে যে সিপাহী আসিয়াছিল, তাহাকে বলিলেন, “গোইন্দাকে ডাক।” সিপাহী এক ছিপের একজন জমাদ্দার সাহেবকে ডাকিয়া বলিল, “গোইন্দাকে ডাক।” তখন গোইন্দাকে ডাকাডাকির গোল পড়িয়া গেল। গোইন্দা কোথায়, গোইন্দা কে, তাহা কেহই জানে না, কেবল চারি দিকে ডাকাডাকি করে।