বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড - বাঙ্গালীর উৎপত্তি
দেখা গিয়াছে যে, এই তৃতীয় শ্রেণীর ভাষাগুলি ধাতু এবং বিভক্তিচিহ্ন লইয়া গঠিত। ধাতুর পর বিভক্তি ও প্রত্যয়বিশেষের আদেশে শব্দ ও ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়। তাহা ছাড়া ভাষায় আর যাহা আছে, তাহাকে সাধারণত: সর্ব্বনাম বলা যাইতে পারে। সর্ব্বনামগুলি যে অবস্থাভ্রষ্ট ধাতু, ইহাও বিবেচনা করিবার কারণ আছে। কিন্তু তাহা হৌক, বা না হৌক, ধাতু, বিভক্তিচিহ্ন ও সর্ব্বনাম লইয়া ভাষা | যদি কোন দুইটি ভাষায় দেখা যায় যে, ভাষার মূলীভূত ধাতু, বিভক্তি ও সর্ব্বনাম একই, কেবল দেশকালভেদে কিছু রূপান্তর প্রাপ্ত হইয়াছে, তবে অবশ্য অনুমান করিতে হইবে যে, ঐ দুইটি ভাষা উভয়েই একটি আদিম ভাষা হইতে উৎপন্ন। ভাষাবিজ্ঞানের অতি বিস্ময়কর আবিষ্ক্রিয়া এই, তৃতীয় শ্রেণীর ভাষাগুলির মধ্যে অনেকগুলি প্রাচীন ও আধুনিক ভাষাতেই ভাষার মূলগত ধাতু, বিভক্তিচিহ্ন ও সর্ব্বনাম এক। অতএব সেই সকল ভাষা যে একটি প্রাচীন মূলভাষা হইতে উৎপন্ন, ইহা সিদ্ধ হইয়াছে। সেই সকল ভাষাগুলি একপরিবারভুক্ত।
ভারতবর্ষের সংস্কৃত এবং সংস্কৃতমূলক পালি প্রভৃতি প্রাচীন ভাষা; বাঙ্গালা, হিন্দী প্রভৃতি সংস্কৃতমূলক আধুনিক ভাষা; জেন্দ, অর্থাৎ প্রাচীন পারস্যের অধিবাসীদিগের ভাষা ও আধুনিক পারসী; প্রাচীন গ্রীক্ ও লাটিন; লাটিন্সম্ভূত ফরাশী, ইতালীয়, স্পেনীয় প্রভৃতি, রোমান্স্জাতীয় ভাষা, টিউটন্বংশীয়দিগের ভাষা, অর্থাৎ জর্ম্মান্, ওলন্দাজি, ইংরেজি; ব্রিটেনীয় আদিমবাসীদিগের কেল্টিক ভাষা, স্কটলণ্ডের পার্ব্বত্যদেশের গেলিক্ দিনেমারি, সুইডেনি, নরওয়ের ভাষা, রুস্ প্রভৃতি স্লাবনিক্ ভাষা,—সকলই সেই এক প্রাচীনা ভাষা হইতে উৎপন্না,—সকলেই সেই এক বৃদ্ধা মাতার দুহিতা। সেই বহুভাষার জননী প্রাচীনা ভাষা এখন আর নাই—কিন্তু একদিন ছিল। যেমন কোন গৃহে, কতকগুলি মাতৃহীন ভ্রাতা ও ভগিনী বাস করিতেছে দেখিয়া অনুমান করি যে, ইহাদের একজন জননী ছিল, তেমনি একই একবংশীয় বহুতর ভাষা দেখিয়া মনে করি যে, এক প্রাচীন মূল ভাষা ছিল। যে জাতি ঐ ভাষা ব্যবহার করিতেন, তাঁহারা আর্য্যজাতি বলিয়া অধুনা নামপ্রাপ্ত হইয়াছেন। সেই ভাষাসমুৎপন্ন ভাষাগুলি আর্য্যভাষা নামপ্রাপ্ত হইয়াছে। যে সকল জাতির ভাষা আর্য্যভাষা, তাহারা আর্য্যবংশীয় বলিয়া অনুমিত এবং বর্ণিত হইয়া থাকে। যাহারা আর্য্যবংশসম্ভূত নহে, তাহারা অনার্য্যজাতি।
এখন কোল, সাঁওতাল, কোঁচ, কাছাড়ি প্রভৃতি জাতিদিগের ভাষা যাঁহারা অধ্যয়ন করিয়াছেন, তাঁহারা বলেন যে, এই সকল ভাষা প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত—এই সকল ভাষার বিভক্তি নাই। অতএব এই সকল ভাষা অনার্য্যভাষা। যে সকল জাতির মাতৃভাষা অনার্য্যভাষা, সে সকল জাতি অনার্য্যজাতি। কোল, সাঁওতাল, মেছ, কাছাড়ি অনার্য্য জাতি। আর্য্য ও অনার্য্য, এ ভেদের তাৎপর্য্য এই। এখন আর্য্যদিগের সম্বন্ধে একটা কথা বলিব।
সে কথা এই যে, প্রাচীন আর্য্যজাতি—যাঁহারা পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠ জাতির এবং আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষ—তাঁহারা কোথায় বাস করিতেন? ভারতবর্ষীয়েরা বলিতে পারেন—ভারতই আর্য্যভূমি—ভারতবর্ষের সংস্কৃতভাষা সকল আর্য্যভাষা হইতে প্রাচীনা দেখা যাইতেছে। তবে আর্য্যবংশের আদিম বাস ভারতবর্ষ; ভারতবর্ষ হইতে তাঁহারা দলে দলে অন্য দেশে গিয়াছেন, এ কথা বলিব কেন? অতি প্রাচীন কালেও মনু যবন প্রভৃতি জাতিকে ভ্রষ্টক্ষত্রিয় বলিয়াছেন।