কমলাকান্ত-কমলাকান্তের দপ্তর
“আমায় নারী না করিত বিধি
তোমা হেন গুণবিধি
লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ।”
তোমা হেন গুণবিধি
লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ।”
প্রথমে আহ্বান, “এসো এসো বঁধু এসো,” পরে আদর, “আঁধ আঁচরে বসো,” পরে ভোগ “নয়ন ভরিয়া তোমায় দেখি।” তখন সুখভোগকালীন পূর্ব্বদুঃখস্মৃতি-“অনেক দিবসে, মনের মানসে, তোমা ধনে মিলাইল বিধি।” সুখ দ্বিবিধ, সম্পূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ। অসম্পূর্ণ সুখ যথা,
পরে সম্পূর্ণ সুখ,
“আমায় নারী না করিত বিধি,
তোমা হেন গুণনিধি,
লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ!”
তোমা হেন গুণনিধি,
লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ!”
সম্পূর্ণ অসহ্য সুখের লক্ষণ, শারীরিক চাঞ্চল্য, মানসিক অস্থৈর্য্য। এ সুখ কোথায় রাখিব, লইয়া কি করিব, আমি কোথায় যাইব, এ সুখের ভার লইয়া কোথায় ফেলিব? এ সুখের ভার লইয়া আমি দেশে দেশে ফিরিব; এ সুখ এক স্থানে ধরে না; যেখানে যেখানে পৃথিবীতে স্থান আছে, সেইখানে সেইখানে এ সুখ লইয়া যাইব, এ জগৎ সংসার এই সুখে পুরাইব। সংসার এ সুখের সাগরে ভাসাইব; মেরু হইতে মেরু পর্য্যন্ত সুখের তরঙ্গ নাচাইব, আপনি ডুবিয়া, উঠিয়া, ভাসিয়া, হেলিয়া, ছুটিয়া বেড়াইব। এ সুখে কমলাকান্তের অধিকার নাই-এ সুখে বাঙ্গালির অধিকার নাই। সুখের কথাতেই বাঙ্গালির অধিকার নাই। গোপীর দুঃখ, বিধাতা গোপীকে নারী করিয়াছেন কেন-আমাদের দুঃখ, বিধাতা আমাদের নারী করেন নাই কেন-তাহা হইলে এ মুখ দেখাইতে হইত না।
সুখের কথায় বাঙ্গালির অধিকার নাই-কিন্তু দুঃখের কথায় আছে। কাতরোক্তি যত গভীর যতই হৃদয়বিদারক হউক না কেন, তাহা বাঙ্গালির মর্ম্মোক্তি।-আর কাতরোক্তি, কোথায় বা নাই? নবপ্রসূত পক্ষিশাবক হইতে মহাদেবের শৃঙ্গধ্বনি পর্য্যন্ত সকলই কাতরোক্তি। সম্পূর্ণ-সুখে সুখীও সুখকালে পূর্ব্বদুঃখ স্মরণ করিয়া কাতরোক্তি করে। নহিলে সুখের সম্পূর্ণতা কি? দুঃখস্মৃতি ব্যতীত সুখের সম্পূর্ণতা কোথায়? সুখও দুঃখময়-
“তোমায় যখন পড়ে মনে,
আমি চাই বৃন্দাবন পানে,
আলুইলে কেশ নাই বাঁধি।”
আমি চাই বৃন্দাবন পানে,
আলুইলে কেশ নাই বাঁধি।”
এই কথা সুখ দুঃখের সীমারেখা! যাহার নষ্ট সুখের স্মৃতি জাগরিত হইলে সুখের নিদর্শন এখনও দেখিতে পায়, সে এখনও সুখী-তাহার সুখ একেবারে লুপ্ত হয় নাই। তাহার বন্ধু, তাহার প্রিয়, বাঞ্ছিত-গিয়াছে, কিন্তু তাহার বৃন্দাবন আছে-মনে করিলে, সে সেই সুখভূমি পানে চাহিতে পারে। যাহার সুখ গিয়াছে-সুখের নিদর্শন গিয়াছে-বঁধু গিয়াছে, বৃন্দাবনও গিয়াছে, এখন আর চাহিবার স্থান নাই-সেই দুঃখী, অনন্ত দুঃখে দুঃখী। বিধবা যুবতী, মৃত পতির যত্নরক্ষিত পাদুকা হারাইলে, যেমন দুঃখে দুঃখী হয়, তেমনিই দুঃখে দুঃখী।