বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড
বাঙ্গালার ইতিহাসের ভগ্নাংশ *
কামরূপ—রঙ্গপুর
কোন দেশের ইতিহাস লিখিতে গেলে সেই দেশের ইতিহাসের প্রকৃত যে ধ্যান, তাহা হৃদয়ঙ্গম করা চাই। এই দেশ কি ছিল? আর এখন এ দেশ যে অবস্থায় দাঁড়াইয়াছে, কি প্রকারে-কিসের বলে এ অবস্থান্তর প্রাপ্তি, ইহা আগে না বুঝিয়া ইতিহাস লিখিতে বসা অনর্থক কালহরণ মাত্র। আমাদের কথা দূরে থাক, ইংরেজ ইতিহাসবেত্তাদিগের মধ্যে এই ভ্রান্তির বাড়াবাড়ি হইয়াছে। “বাঙ্গালার ইতিহাস” ইহার এক প্রমাণ। বাঙ্গালার ইতিহাস পড়িতে বসিয়া আমরা পড়িয়া থাকি, পালবংশ সেনবংশ বাঙ্গালার রাজা ছিলেন, বখ্তিয়ার খিলিজি বাঙ্গালা জয় করিলেন, পাঠানেরা বাঙ্গালায় রাজা হইলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সকলই ভ্রান্তি; কেন না সেন, পাল ও বখ্তিয়ারের সময় বাঙ্গালা কোন রাজ্য ছিল না। এখনকার এই বাঙ্গালা দেশের কোন নামান্তরও ছিল না। সেন ও পাল গৌড়ের রাজা ছিলেন, বখ্তিয়ার খিলিজি লক্ষ্মণাবতী জয় করিয়াছিলেন। গৌড় বা লক্ষ্ণাবতী বাঙ্গলার প্রাচীন নাম নহে। বাঙ্গালী বলিয়া কোন জাতি তথাকার অধিবাসী ছিল না। যাহাকে এখন বাঙ্গালা বলি, গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী তাহার এক অংশ মাত্র। সে দেশে যাহারা বাস করিত, তাহারা অন্য জাতির সঙ্গে মিশ্রিত হইয়া আধুনিক বাঙ্গালী হইয়াছে। যেমন গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী একটি রাজ্য ছিল, তেমনি আরও অনেকগুলি পৃথক্ রাজ্য ছিল। সেগুলি বাঙ্গালার অংশ ছিল না; কেন না, বাঙ্গালাই তখন ছিল না। সেগুলি কোন একটি রাজ্যের অংশ ছিল না—সকলই পৃথক্ পৃথক্ স্বস্বপ্রধান। সকলেই ভিন্ন ভিন্ন অনার্য্যজাতির বাসভূমি। ভিন্ন দেশে ভিন্ন জাতি। কিন্তু সর্বত্র প্রায় আর্য্যপ্রধান; এই আর্য্যেরাই এই ভিন্ন দেশগুলি একীভূত করিবার মূল কারণ। যে দেশে যে জাতি থাকুক না কেন, যাহারা আর্য্যদিগের ভাষা গ্রহণ করিল, আর্য্যদিগের ধর্ম্ম গ্রহণ করিল। আগে একধর্ম্ম, একভাষা, তার পর শেষে একচ্ছত্রাধীন হইয়া আধুনিক বাঙ্গালায় পরিণত হইল।
কিন্তু সেই একচ্ছত্রাধীনত্ব সম্প্রতি হইয়াছে মাত্র, ইংরেজের সময়ে। বাঙ্গালীর দেশ, মুসলমানেরা কখনই একচ্ছত্রাধীন করিতে পারেন নাই। মোগলেরা অনেক দূর করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহারাও আধুনিক বাঙ্গালার অধীশ্বর হইতে পারেন নাই।
অতএব যে অর্থে গ্রীসের ইতিহাস আছে, রোমের ইতিহাস আছে, সে অর্থে বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। যেমন আধুনিক ফ্লোরেন্সের ইতিহাস লিখিলে বা মিলানের ইতিহাস লিখিলে বা নেপ্ল্সের ইতিহাস লিখিলে আধুনিক ইতালির ইতিহাস লেখা হয় না, বাঙ্গালারও কতক তেমনি। কিন্তু ইতালি বলিয়া দেশ ছিল; বাঙ্গালা বলিয়া দেশ ছিল না। বাঙ্গালার ইতিহাস আরম্ভ মোগলের সময় হইতে।
আমরা বাঙ্গালার ঐতিহাসিক ধ্যান এখন আর পরিস্ফুট না করিয়া, যাহা বলিতেছি বা বলিব, আগে তাহার প্রমাণ সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইব। প্রথমে উত্তর পূর্ব্ব বাঙ্গালার কথা বলিব। দেখা যাউক, কবে এ অংশ বাঙ্গালাভুক্ত হইয়াছে, কবেই বা বাঙ্গালার সংস্পর্শে আসিয়াছে।
*বঙ্গদর্শন, ১২৮৯, জ্যৈষ্ঠ।