লোকরহস্য
পণ্ডিত মহাশয় আর সহ্য করিতে পারিলেন না। বিরাশী সিক্কা ওজনে ছাত্রের গাছে এক চপেটাঘাত করিলেন। ছাত্র পুস্তকাদি ফেলিয়া দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী চলিয়া গেল। তখন বৃষ্টি ধরিয়া আসিয়াছিল, রঙ্গ দেখিবার জন্য আমিও সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। ভোঁদার মাতার গৃহ বিদ্যালয় হইতে বড় বেশী দূর নয়। ভোঁদা গৃহপ্রবেশকালে কান্নার স্বর দ্বিগুণ বাড়াইল, এবং আছাড়িয়া পড়িল। দেখিয়া ভোঁদার মা তার কাছে এসে সান্ত্বনায় প্রবৃত্ত হইল। জিজ্ঞাসা করিল “কেন, কি হয়েছে বাবা?”
ছেলে মাকে ভেঙ্গাইয়া বলিল, “এখন কি হয়েছে, বাবা! এমন ইস্কুলে আমায় পাঠাইয়েছিলি কেন পোড়ারমুখী?”
মা। কেন, কি হয়েছে, বাবা?
ছেলে । পোড়ারমুখী এখন বলেন, কি হয়েছে বাবা! শিগ্গির তোর ভূ ধাতুর পর ক্ত হৌক। শিগ্গির হৌক! আমি তোর শ্রাদ্ধ করি।
মা। সে আবার কি বাপ! কাকে বলে?
ছেলে । শিগ্গির তোর ভূ ধাতুর উপর ক্ত হৌক। শিগ্গির হৌক।
মা। সে কি মরাকে বলে বাপ?
ছেলে । তা না ত কি? আমি তাই বল্তে পারি নাই ব’লে পণ্ডিত মশাই আমায় মেরেছে।
মা। অধঃপেতে মিন্সে। আক্কেল নেই! আমার এই এক রত্তি ছেলের আর কত বিদ্যা হবে! যে কথা কেউ জানে না, তাই বলতে পারি নি ব’লে ছেলেকে মারে! আজ মিন্সেকে আমি একবার দেখ্বো।
এই বলিয়া গাছকোমর বাঁধিয়া ভোঁদার মাতা পণ্ডিত মহাশয়ের দর্শনাকাঙ্ক্ষায় চলিলেন। আমিও পিছু পিছু চলিলাম। সেই সুপুত্রবতীকে অধিক দূর যাইতে হইল না। তখন পাঠশালা বন্ধ হইয়াছিল। পণ্ডিত মহাশয় গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিলেন, পথিমধ্যেই উভয়ের সাক্ষাৎ হইল। তখন ভোঁদার মা বলিল, “হ্যাঁ গা, পণ্ডিত মহাশয়, যা কেউ জানে না, আমার ছেলে তাই বল্তে পারে নি ব’লে এমনি মার মার্তে হয়?”
পণ্ডিত । ও গো এমন কিছু শক্ত কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। কেবল জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ভূত কেমন করে হয়।
ভোঁদার মা। ভূত হয় গঙ্গা না পেলেই। তা ও সব কথা ও ছেলেমানুষ কেমন ক’রে জান্বে গা? ও সব কথা আমাদের জিজ্ঞাসা কর।
পণ্ডিত । ও গো, সে ভূত নয় গো।
ভোঁদার মা। তবে কি গোভূত?
পণ্ডিত । সে সব কিছু নয় গো, তুমি মেয়েমানুষ কি বুঝবে? বলি, একটা ভূত শব্দ আছে।
ভোঁদার মা। ভূতের শব্দ আমি অমন কত শুনেছি। তা ও ছেলেমানুষ, ওকে কি ও সব কথা ব’লে ভয় দেখাতে আছে?
আমি দেখিলাম যে, এ পণ্ডিতে পণ্ডিতে সমস্যা, শীঘ্র মিটিবে না। আমি এ রঙ্গের অংশ পাইবার আকাঙ্ক্ষায় অগ্রসর হইয়া পণ্ডিত মহাশয়কে বলিলাম, “মহাশয়, ও স্ত্রীলোক, ওর সঙ্গে বিচার ছেড়ে দিন। আমার সঙ্গে বরং এ বিষয়ের কিছু বিচার করুন |”
পণ্ডিত মহাশয় আমাকে ব্রাহ্মণ দেখিয়া, একটু সম্ভ্রমের সহিত বলিলেন, “আপনি প্রশ্ন করুন |”
আমি বলিলাম, “আচ্ছা, ভূত ভূত করিতেছেন, বলুন দেখি ভূত কয়টি?”
পণ্ডিত সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “ভাল, ভাল। পণ্ডিতে পণ্ডিতের মত কথা কয়। শুন্লি মাগী?” তার পর আমার দিকে ফিরিয়া, এমনই মুখখানা করিলেন, যেন বিদ্যার বোঝা নামাইতেছেন। বলিলেন, “ভূত পাঁচটি |”
তখন ভোঁদার মা গর্জ্জিয়া উঠিয়া বলিল, “তবে রে মিন্সে? তুই এই বিদ্যায় আমার ছেলে মারিস্! ভূত পাঁচটা! পাঁচ ভূত, না বারো ভূত?”