বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড - গৌরদাস বাবাজির ভিক্ষার ঝুলি
বাবাজি। উহা কালের চক্র। কল্পে কল্পে, যুগে যুগে, মন্বন্তরে মন্বন্তরে কাল বিবর্ত্তনশীল। তাই কাল ঈশ্বর-হস্তে চক্রাকারে আছে। আকাশ, কাল, শক্তি ও সৃষ্টি, জগদীশ্বর চারি ভূজে এই চারিটি ধারণ করিতেছেন। এখন বুঝিলে, বিষ্ণুর শরীর নাই। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠেশ্বর, ইহার তাৎপর্য্য এই যে, কুণ্ঠাশূন্য ভয়মুক্ত বৈরাগী, ঈশ্বরকে স্রষ্টা, পাতা, হর্ত্তা বলিয়া অনুক্ষণ হৃদয়ে ধ্যান করে।
বাবু। তাই বলিলেই ত ফুরাইত। সবাই ত তা স্বীকার করে, আবার এ রূপকল্পনা কেন?
বাবাজি। সবাই স্বীকার করিবে, কলিকাতা ইংরেজের; তবে আবার একটা মাস্তুল খাড়া করিয়া তাতে ইংরেজের নিশান উড়াইবার দরকার কি? পৃথিবীর সবই এইরূপ কল্পনাতে চলিতেছে; তবে আমার মত মূর্খের ভক্তির পথে কাঁটা দিবার এত চেষ্টা কেন?
বাবু। আচ্ছা, যথার্থই যদি বিষ্ণুর অশরীরী, তবে নীল বর্ণ কার? অশরীরীর আবার বর্ণ কি?
বাবাজি। আকাশের ত নীল বর্ণ দেখি—আকাশ কি শরীরী? ভাল, তোমাদের ইংরেজি শস্ত্রে কি বলে? জগৎ অন্ধকার, না আলো?
বাবু। জগৎ অন্ধকার।
বাবাজি। তাই বিশ্বরূপ বিশ্ব নীলবর্ণ।
বাবু। কিন্তু জগতে মাঝে মাঝে সূর্য্যও আছে—আলোও আছে।
বাবাজি। বিষ্ণুর হৃদয়ে কৌস্তুভ মণি আছে। কৌস্তুভ—সূর্য্য; বনমালা—গ্রহ-নক্ষত্রাদি।
বাবু। ভাল, জগৎই বিষ্ণু?
বাবাজি। না। যিনি জগতে সর্ব্বত্র প্রবিষ্ট, তিনিই বিষ্ণু। জগৎ শরীর, তিনি আত্মা।
বাবু। ভাল, যিনি অশরীরী জগদীশ্বর, তাঁর আবার দুইটা বিয়ে কেন? বিষ্ণুর দুই পরিবার, লক্ষ্মী আর সরস্বতী।
বাবাজী। অভিধান কিনিয়া পড়িয়া দেখ, লক্ষ্মী অর্থে সৌন্দর্য্য। শ্রী, রমা প্রভৃতি লক্ষ্মীর আর আর নামেরও সেই অর্থ। সরস্বতী জ্ঞান। বিষ্ণু, সৎ, সরস্বতী চিৎ, আর লক্ষ্মী আনন্দ। অতএব রে মূর্খ! এই সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্মাকে প্রণাম কর।
সর্ব্বনাশ! রামবল্লভাবাবুকে, তাঁহার স্বভবনে, “রে মূর্খ!” সম্বোধন! রাজবল্লভ-বাবু তখনই দ্বারবান্কে হুকুম দিলেন, “মারো বদ্জাত্কো!”
আমি বাবাজির ঝুলি ধরিয়া তাঁহাকে টানিয়া বাহির করিয়া দুই জনে সরিয়া পড়িলাম। বাহিরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “বাবাজি! আজিকার ভিক্ষায় পেলে কি?”
বাবাজি বলিলেন, “বদ পূর্ব্বক জন ধাতুর উত্তর ক্ত করিয়া যা হয়, তাই। ভিক্ষার ধনটা ঝুলির ভিতর লুকাইয়া রাখ |”
শ্রী হরিদাস বৈরাগী