চিত্তশুদ্ধি

হিন্দুধর্ম্মের সার চিত্তশুদ্ধি যাহারা হিন্দুধর্ম্মের বিশেষ অনুরাগী অথবা হিন্দুধর্ম্মের যথার্থ মর্ম্মের অনুসন্ধানে ইচ্ছুক, তাহাদিগকে এই তত্ত্বের প্রতি বিশেষ মনোযোগ করিবার জন্য অনুরোধ করি। হিন্দুধর্ম্মান্তর্গত আর কোন তত্ত্বই ইহার ন্যায় মর্ম্মগত নহে। সাকারের উপাসনা বা নিরাকারের উপাসনা, একেশ্বরবাদ বা বহুদেবে ভক্তি, দ্বৈতবাদ বা অদ্বৈতবাদ, জ্ঞানবাদ, কর্ম্মবাদ বা ভক্তিবাদ, সকলই ইহার নিকট অকিঞ্চিৎকর। চিত্তশুদ্ধি থাকিলে সকল মতই শুদ্ধ, চিত্তশুদ্ধির অভাবে সকল মতই অশুদ্ধ। যাহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তাহার কোন ধর্ম্মই নাই। চিত্তশুদ্ধি কেবল হিন্দুধর্ম্মেরই সার, এমত নহে, ইহা সকল ধর্ম্মের সার। ইহা হিন্দুধর্ম্মের সার, খ্রীষ্টধর্ম্মের সার, বৌদ্ধধর্ম্মের সার, ইসলামধর্ম্মের সার, নিরীশ্বর কোমৎধর্ম্মেরও সার। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি আছে, তিনি শ্রেষ্ঠ হিন্দু, শ্রেষ্ঠ খ্রীষ্টীয়ান, শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ, মুসলমান, শ্রেষ্ঠ পজিটিভিস্ট্। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তিনি কোন ধর্ম্মাবলম্বীদিগের মধ্যে ধার্ম্মিক বলিয়া গণ্য হইতে পারেন না। চিত্তশুদ্ধিই ধর্ম্ম। তবে প্রধানতঃ হিন্দুধর্ম্মেই ইহা প্রবল। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তিনি হিন্দু নহেন। মন্বাদি ধর্ম্মশাস্ত্রের সমস্ত বিধি বিধানানুসারে কার্য্য করিলেও তিনি হিন্দু নহেন।

এই চিত্তশুদ্ধি কি, তাহা দুই একটা লক্ষণের দ্বারা বুঝাইতেছি। চিত্তশুদ্ধির প্রথম লক্ষণ ইন্দ্রিয় সংযম। “ইন্দ্রিয় সংযম” ইতি বাক্যের দ্বারা এমন বুঝিতে হইবে না যে, ইন্দ্রিয়সকলের একবারে উচ্ছেদ বা ধ্বংস করিতে হইবে। ইন্দ্রিয়গণকে সংযত করিতে হইবে, কেবল ইহাই বুঝিতে হইবে। উদারহণ, ঔদরিকতা একজাতীয় ইন্দ্রিয়পরতা, কিন্তু এ ইন্দ্রিয়ের সংযমবিধিতে এমন বুঝিতে হইবে না যে, পেটে কখন খাইবে না বা কেবল বায়ু ভক্ষণ করিবে বা কদর্য্য আহার করিয়া থাকিবে। শরীররক্ষার জন্য এবং স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যে পরিমাণ এবং যে প্রকার আহারের প্রয়োজন, তাহা অবশ্য করিতে হইবে, তাহাতে ইন্দ্রিয়সংযমের কোন বিঘ্ন হয় না। ইন্দ্রিয়সংযম তত কঠিন ব্যাপার নহে। ইহাও বলা যাইতে পারে যে, সংযতেন্দ্রিয়ের পক্ষে উত্তম আহারাদিও অবিধেয় নহে, যদি তাহাতে স্পৃহা না থাকে।# স্থূল কথা এই যে, ইন্দ্রিয়ে আসক্তির অভাবই ইন্দ্রিয়সংযম। আত্মরক্ষার্থে বা ধর্ম্মরক্ষার্থে অর্থাৎ ঐশিক নিয়মরক্ষার্থে যতটুকু ইন্দ্রিয়ের চরিতার্থতা আবশ্যক, তাহার অতিরিক্ত যে ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তির অভিলাষ করে, তাহারই ইন্দ্রিয় সংযত হয় নাই; যে না করে, তাহার হইয়াছে | ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তিতে সুখ নাই, আকাঙ্ক্ষা নাই, কেবল ধর্ম্মরক্ষা আছে, তাহারই ইন্দ্রিয় সংযত হইয়াছে।

*প্রচার, ১২৯২, ফাল্গুন

#রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্।

আত্মবশ্যৈর্ব্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি|| গীতা। ২য় অ। ৬৪।

অর্থ। রাগ দ্বেষ হইতে বিমুক্ত আত্মবশ্য যে ইন্দ্রিয়গণ, তদ্দ্বারা বিষয়সকল উপভোগ করিয়া বিধেয়াত্মা ব্যক্তি শান্তি প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।