বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড - প্রাচীনা এবং নবীনা
প্রাচীনের অপেক্ষা নবীনের গুণের মধ্যে দেখি, তোমরা একটু ইংরেজি শিখিয়াছ। কিন্তু ইংরেজি শিখিয়া কাহার কি উপকার করিয়াছ? ইংরেজি শিখিয়া কেরাণীগিরি শিখিয়াছ দেখিতে পাই। কিন্তু মনুষ্যত্ব? শুন, প্রাচীন নবীনে প্রভেদ কি, বলি। প্রাচীনেরা পরোপকারী ছিলেন; তোমরা আত্মোপকারী। প্রাচীনেরা সত্যবাদী ছিলেন; তোমরা কেবল প্রিয়বাদী। প্রাচীনেরা ভক্তি করিতেন পিতা-মাতাকে; নবীনের ভক্তি করা পত্নী বা উপপত্নীকে। প্রাচীনেরা দেবতা ব্রাহ্মণের পূজা করিতেন; তোমাদের দেবতা টেস ফিরিঙ্গি, তোমাদের ব্রাহ্মণ সোনার বেনে। সত্য বটে, তাঁহারা পৌত্তলিক ছিলেন, কিন্তু তোমরা বোতলিক। জগদীশ্বরীর স্থানে তোমরা অনেকেই ধ্যান্যেশ্বরীকে স্থাপনা করিয়াছে; ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের স্থানে ব্রাণ্ডি, রম, জিন। বিষয়, সেরি তোমাদের ষষ্ঠী মনসার মধ্যে। বঙ্গীয় বাবুর ভ্রাতৃস্নেহ সম্বন্ধীর উপর বর্ত্তিয়াছে, অপত্যস্নেহ ঘোড়া কুকুরের উপর বর্ত্তিয়াছে; পিতৃভক্তি আপিসের সাহেবের উপট বর্ত্তিয়াছে, আর মাতৃভক্তি? পাচিকার উপরে। আমরা অতিথি অভ্যাগত দেখিলে মহা বিপদ্ মনে করি বটে, তোমরা তাহাদিগকে গলা ধাক্কা দাও। আমরা অলস; তোমরা শুধু অলস নও—তোমরা বাবু! তবে ইংরেজ বাহাদুর নাকে দড়ি দিয়া তোমাদের ঘানিগাছে ঘুরায়, বল নাই বলিয়া ঘোর। আর আমরাও নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাই, বুদ্ধি নাই বলিয়া ঘোর। আমরা লেখাপড়া শিখি নাই বলিয়া আমাদের ধর্ম্মের বন্ধন নাই, আর তোমাদের? তোমাদের ধর্ম্মের বন্ধন বড় দৃঢ়, কেন না, তোমাদের সে বন্ধনের দড়ি একদিকে শুঁড়ি, আর একদিকে বারস্ত্রী টানিয়া আঁটিয়া দিতেছে; তোমরা ধর্ম্ম-দড়িতে মদের কলসী গলায় বাঁধিয়া, প্রেমসাগরে ঝাঁপ দিতেছ—গরিব “নবীনা” খুনের দায়ে ধরা পড়িতেছে। তোমাদের আবার ধর্ম্মের ভয় কি?তোমরা কি মান? ঠাকুর দেবতা? যিশুখ্রীষ্ট? ধর্ম্ম মান? পাপ পুণ্য মান? কিছু না—কেবল আমাদের এই আলতা-পরা মল-বেড়া শ্রীচরণ; সেও নাথির জ্বালায়।
শ্রীচণ্ডিকাসুন্দরী দেবী
নং ২
সম্পাদক মহাশয়! আপনাদের শ্রীচরণে এ কিঙ্করীকুল কোন্ দোষে দোষী? আমরা কি জানি?—আপনারা শিখাইবেন, আমরা শিখিব—আপনারা গুরু, আমরা শিষ্য,—কিন্তু শিক্ষাদান এক, নিন্দা আর। বঙ্গদর্শনে “নবীনার” প্রতি এত কটূক্তি কেন?
আমাদের সহস্র দোষ আছে স্বীকার করি। একে স্ত্রীজাতি, তাতে বাঙ্গালির মেয়ে, জাতিতে কাঠমল্লিকা, তাহাতে মরুভূমে জন্মিয়াছি—দোষ না থাকিবে কেন? তবে কতকগুলি দোষ আপনাদেরই গুণে জন্মিয়াছে। আপনাদের গুণে, দোষে নহে। আপনারা আমাদের এত ভাল না বাসিলে, আমাদের এত দোষ ঘটিত না। আপনারা আমাদের সুখী করিয়াছেন, এজন্য আমরা অলস। মাথার ফুলটি খসিয়া পড়িলে, আপনারা তুলিয়া পরান। আপনারা জল হইয়া যে নলিনী হৃদয়ে ধারণ করেন, সে কেন স্বচ্ছ সলিলে আপনারা রূপের ছায়া দেখিয়া দিন না কাটাইবে?
আমরা অতিথি অভ্যাগতের প্রতি অমনোযোগী—তাহার কারণ, আমরা স্বামী পুত্রের প্রতি অধিক মনোযোগী। আমাদের ক্ষুদ্র হৃদয়ে আপনারা এত স্থান গ্রহণ করিয়াছেন যে, অন্য ধর্ম্মের আর স্থান নাই।
আর—শেষ কথা, আমরা কি ধর্ম্মভীতা নহি? ছি! ধর্ম্মভীতা বলিয়াই, আপনাদিগকে আর কিছু বলিতে পারিলাম না। তোমরাই আমাদিগের ধর্ম্ম। তোমাদের ভয়ে ভীতা বলিয়া, অন্য ধর্ম্মের ভয় করি না। সকল ধর্ম্ম কর্ম্ম আমরা স্বামী পুত্রে সমর্পণ করিয়াছি—অন্য ধর্ম্ম জানি না। লেখাপড়া শিখাইয়া আমাদিগকে কোন্ ধর্ম্মে বাঁধিবেন? যত শিখান না কেন—আমরা বাঙ্গালির মেয়ে, সকল বন্ধন ছিঁড়িয়া এই পাতিব্রত্য বন্ধনে আপনা আপনি বাঁধা পড়িব। যদি ইহাতে অধর্ম্ম হয়, সে আপনাদের দোষ, আপনাদেরই গুণ। আর যদি আমার ন্যায় মুখরা বালিকার কথায় রাগ না করেন, তবে জিজ্ঞাসা করি, আপনারা গুরু, আমরা শিষ্য—আপনারা আমাদের কোন ধর্ম্ম শিখাইয়া থাকেন?
লেখাপড়া শিখিব? কেন? তোমাদের মুখচন্দ্র দেখিয়া যে সুখ, লেখাপড়ায় কি তত? তোমাদের সুখসাধনে যে ধর্ম্মশিক্ষা, লেখাপড়ায় কি তত? দেখ, তোমাদের দেখিয়া আমরা আত্মবিসর্জন শিখিয়াছি, লেখাপড়ায় কি তাহা শিখাইবে? আর লেখাপড়া শিখিব কখন? তোমাদের মুখ ভাবিতে ভাবিতে দিন যায়, ছাই লেখাপড়া শিখিব কখন?
ছি! দাসীদিগের নিন্দা!
শ্রীলক্ষ্মীমণি দেবী।