বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড - সাংখ্যদর্শন
ঈশ্বর না মানিয়াও কেন বেদ মানেন, তাহা আমরা পরপরিচ্ছেদে দেখাইব। সাংখ্যের এই নিরীশ্বরতা বৌদ্ধধর্ম্মের পূর্ব্বসূচনা বলিয়া বোধ হয়।
ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বন্ধে সাংখ্যদর্শনের একটি কথা বাকি রহিল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, অনেকে বলেন, কাপিল দর্শন নিরীশ্বর নহে। এ কথা বলিবার কিছু একটু কারণ আছে। তৃ, অ, ৫৭ সূত্রে সূত্রকার বলেন, “ঈদৃশেশ্বরসিদ্ধিঃ সিদ্ধা |” সে কি প্রকার ঈশ্বর? “স হি সর্ব্ববিৎ সর্ব্বকর্ত্তা,” ৩, ৫৬। তবে সাংখ্য নিরীশ্বর হইল কই?
বাস্তবিক এ কথা ঈশ্বর সম্বন্ধে উক্ত হয় নাই। সাংখ্যকার বলেন, জ্ঞানেই মুক্তি, আর কিছুতেই মুক্তি নাই। পুণ্যে, অথবা সত্ত্ববিশ্বাল ঊর্দ্ধ্বলোকেও মুক্তি নাই; কেন না, তথা হইতে পুনর্জ্জন্ম আছে, এবং জরামরণাদি দুঃখ আছে। শেষ এমনও বলেন যে, জগৎকারণে লয় প্রাপ্ত হইলেও মুক্তি নাই; কেন না, তাহা হইতে জলমগ্নের পুনরুত্থানের ন্যায় পুনরুত্থান আছে (৩, ৫৪)। সেই লয়প্রাপ্ত আত্মা সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন যে, তিনি “সর্ব্ববিৎ এবং সর্ব্বকর্ত্তা |” ইহাকে যদি ঈশ্বর বলিতে চাও, তবে ঈদৃশেশ্বর সিদ্ধ। কিন্তু ইনি জগৎস্রষ্টা বা বিধাতা নহেন। “সর্ব্বকর্ত্তা” অর্থে সর্ব্বশক্তিমান, সর্ব্বসৃষ্টিকারক নহে।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ—বেদ
আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, সাংখ্যপ্রবচনকার ঈশ্বর মানেন না, বেদ মানেন। বোধ হয়, পৃথিবীতে আর কোন দর্শন বা অন্য শাস্ত্র নাই, যাহাতে ধর্ম্মপুস্তকের প্রমান্য স্বীকার করে অথচ ধর্ম্মপুস্তকের বিষয়ীভূত এবং প্রণেতা জগদীশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। এই বেদভক্তি ভারতবর্ষে অতিশয় বিস্ময়কর পদার্থ। আমরা এ বিষয়টি কিঞ্চিৎ সবিস্তারে লিখিতে ইচ্ছা করি।
মনু বলেন, বেদশব্দ হইতে সকলের নাম কর্ম্ম, এবং অবস্থা নির্ম্মিত হইয়াছিল। বেদ, পিতৃ, দেবতা এবং মনুষ্যের চক্ষু; অশক্য অপ্রমেয়; যাহা বেদ হইতে ভিন্ন, তাহা পরকালে নিষ্ফল, বেদ ভিন্ন গ্রন্থ মিথ্যা। ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান, শব্দ স্পর্শ রূপ গন্ধ, চতুর্ব্বর্ণ, ত্রিলোক, চতুরাশ্রম, সকলই বেদ হইতে প্রকাশ; বেদ মনুষ্যের পরম সাধন; যে বেদজ্ঞ, সেই সৈনাপত্য, রাজ্য, দণ্ডনেতৃত্ব এবং সর্ব্বলোকাধিপত্যের যোগ্য। যে বেদজ্ঞ, সে যে আশ্রমেই থাকুক না কেন, সেই ব্রহ্মে লীন হওয়ার যোগ্য | যাহারা ধর্ম্ম-জিজ্ঞাসু, বেদই তাহাদের পক্ষে পরম প্রমাণ। বেদ অজ্ঞের শরণ, জ্ঞানীদেরও শরণ। যাহারা স্বর্গ বা আনন্ত্য কামনা করে, ইহাই তাহাদিগের শরণ। যে ব্রাহ্মণ তিন লোক হত্যা করে, যেখানে যেখানে খায়, তাহার যদি ঋগ্বেদ মনে থাকে, তবে তাহার কোন পাপ হয় না।
শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, বেদান্তর্গত সর্ব্বভূত। বেদ, সকল ছন্দঃ, স্তোম, প্রাণ, এবং দেবতা গণের আত্মা। বেদই আছে। বেদ অমৃত। যাহা সত্য, তাহাও বেদ।
বিষ্ণুপুরাণে আছে, দেবাদির রূপ, নাম, কর্ম্ম, প্রবর্ত্তন, বেদশব্দ হইতে সৃষ্ট হইয়াছিল। অন্যত্র ঐ পুরাণে বিষ্ণুকে বেদময় ও ঋগ্যজুঃসামাত্মক বলা হইয়াছে।
মহাভারতে শান্তিপর্ব্বেও আছে বটে, বেদ শব্দ হইতে সর্ব্বভূতের রূপ নাম কর্ম্মাদির উৎপত্তি।
ঋক্সংহিতার ও তৈত্তিরীয় সংহিতার মঙ্গলাচরণে সায়নাচার্য্য ও মাধবাচার্য্য লিখিয়াছেন, “বেদ হইতে অখিল জগতের নির্ম্মাণ হইয়াছে |”
এইরূপ সর্ব্বত্র বেদের মাহাত্ম্য। কোন দেশে কোন ধর্ম্মগ্রন্থের, বাইবেল, কোরাণ প্রভৃতি কিছুরই ঈদৃশ মহিমা কীর্ত্তিত হয় নাই।