বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড - জ্ঞান
পাঠক আবার দেখিবেন যে, আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন, ফিরিয়া ফিরিয়া সেই প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে মিলিতেছে। যেমন চার্ব্বাকের প্রত্যক্ষবাদে, মিল ও বেনের প্রত্যক্ষবাদের সাদৃশ্য দেখা গিয়াছে, তেমনি বেদান্তের মায়াবাদের সঙ্গে কান্তের এই প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের সাদৃশ্য দেখা যায়। আধ্যাত্মিক তত্ত্বে, প্রাচীন আর্য্যগণ কর্ত্তৃক সূচিত হয় নাই, এমত তত্ত্ব অল্পই ইউরোপে আবিষ্কৃত হইয়াছে।
কান্তীয় আভ্যন্তরিক মতের প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী জন ষ্টুয়ার্ট মিল। তিনি কার্য্যকারণসম্বন্ধের নিত্যত্বের উপর নির্ভর করেন। তিনি বলেন যে, আমরা প্রত্যক্ষের দ্বারা একটি অকাট্য সংস্কার এই লাভ করিয়াছি যে, যেখানে কারণ বর্তমান আছে, সেইখানেই তাহার কার্য্য বর্ত্তমান থাকিবে। যেখানে পূর্ব্বে দেখিয়াছি যে, ক বর্ত্তমান আছে, সেইখানে দেখিয়াছি যে, খ আছে। পুনর্ব্বার যদি কোথাও ক দেখি, তবে আমরা জানিতে পারি যে, খও এখানে আছে; কেন না, আমরা প্রত্যক্ষের দ্বারা জানিয়াছি, যেখানে কারণ থাকে, সেইখানেই তাহার কার্য্য থাকে। সমানান্তরালতা কারণ, এবং সংমিলনবিরহ তাহার কার্য্য; কেন না, আমরা যেখানে যেখানে সমানান্তরালতা প্রত্যক্ষ করিয়াছি, সেইখানে সেইখানে দেখিয়াছি, মিল হয় নাই, অতএব সমানান্তরালতা, সংমিলনবিরহের নিয়ত পূর্ব্ববর্ত্তী। কাজেই আমরা জানিতেছি যে, যখন যেখানে দুইটি সমানান্তরাল রেখা থাকিবে, সেইখানে আর তাহাদিগের মিলন হইবে না। অতএব এ জ্ঞান প্রত্যক্ষমূলক।
শেষ মত হর্বট স্পেন্সরের। তিনিও প্রত্যক্ষবাদী, কিন্তু তিনি বলেন যে, এই প্রত্যক্ষমূলক জ্ঞান সকলটুকু আমাদিগের নিজ প্রত্যক্ষজাত সংস্কার, পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত হওয়া যায়। আমার পূর্ব্বপুরুষদিগের যে প্রত্যক্ষজাত সংস্কার আমি তাহা কিয়দংশ প্রাপ্ত হইয়াছি। আমি যে সেই সকল সংস্কার লইয়া জন্মিয়াছি, এমন নহে—তাহা হইলে সদ্যঃপ্রসূত শিশুও সংস্কারবিশিষ্ট হইত, কিন্তু তাহার বীজ আমার শরীরে (মন শরীরের অন্তর্গত) আছে; প্রয়োজনমত সময়ে জ্ঞানে পরিণত হইবে। এইরূপে, যাহা কান্তীয় মতে আভ্যন্তরিক বা সহজে জ্ঞান, স্পেন্সরের মতে তাহা পূর্ব্বপুরুষপরম্পরাগত প্রত্যক্ষজাত জ্ঞান।
এই কথা আপাততঃ অপ্রামাণিক বোধ হইতে পারে, কিন্তু স্পেন্সর দক্ষতার সহিত ইহার সমর্থন করিয়াছেন যে, ইউরোপে এই মতই এক্ষণে প্রচলিত হইয়া উঠিতেছে। ১
১ অনেকের কোমতের “Positive Philosophy” নামক দর্শনশাস্ত্রের নামানুবাদে প্রত্যক্ষবাদ লিখিয়া থাকেন। আমাদের বিবেচনায় সেটি ভ্রম। যাহাকে “Empirical Philosophy” বলে, অর্থাৎ লক, হূম্ মিল ও বেনের মতকেই প্রত্যক্ষবাদ বলা যায়। আমরা সেই অর্থেই প্রত্যক্ষবাদ শব্দ এই প্রবন্ধে ব্যবহার করিয়াছি।