নিঃসহায় পাদচারী বালকের প্রতি বহু সেনা ধাবমান দেখিয়া চন্দ্রকেতু তাহাদিগকে নিবারণ করিলেন। দেখিয়া লব ভাবিলেন, “কথমনুকম্পতে নাম?” ভারতবর্ষীয় কোন গ্রন্থে এরূপ বাক্য প্রযুক্ত আছে, এ কথা অনেক ইউরোপীয় সহজে বিশ্বাস করিবেন না।

লব কর্ত্তৃক জৃম্ভকাস্ত্র প্রয়োগ বর্ণনা অস্বাভাবিক, অতিপ্রাকৃত, এবং অস্পষ্ট হইলেও, আমরা তাহা উদ্ধৃত না করিয়া থাকিতে পারিলাম না;—

পাতালোদরকুঞ্জপুঞ্জিততমঃশ্যামৈর্নভোজৃম্ভকৈ—
রুত্তপ্তস্ফুরদারকূটকপিলজ্যোতির্জ্বলদ্দীপ্তিভিঃ।
কল্পোক্ষেপকঠোরভৈরবমরুদ্ব্যস্তৈরবাকীর্য্যতে
মীলন্মেঘতড়িৎকড়ারকুহরৈর্বিন্ধ্যাদ্রিকূটৈরিব ||

লবের সহিত রামের রূপসাদৃশ্য দেখিয়া, সুমন্ত্রের মনে একবার আশা জন্মিয়াই, সীতা নাই, এই কথা মনে পড়াতে সে আশা তখনই নিবারিত হইল। ভাবিলেন, “লতায়াং পূর্ব্বলূনায়াং প্রসূনস্যাগমঃ কুতঃ!” বৃদ্ধ সুমন্ত্রের মুখে এই বাক্য শুনিয়া, সহৃদয় পাঠকের রোমিও সম্বন্ধে বৃদ্ধ মণ্টাগুর মুখে কীটদংশিত কুসুমকোরকের উপমা মনে পড়িবে।

ষষ্ঠাঙ্কের বিষ্কম্ভকটি বিশেষ মনোহর। বিদ্যাধরমিথুন গগনমার্গে থাকিয়া লব-চন্দ্রকেতুর যুদ্ধ দেখিতেছিলেন। যুদ্ধে তাঁহাদিগের কথোপকথনে বর্ণিত হইয়াছে। শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় লিখিয়াছেন যে, ভবভূতির কাব্যের “মধ্যে মধ্যে সংস্কৃতে এবং প্রাকৃতে এমত দীর্ঘ সমাসঘটিত রচনা আছে, তাহাতে অর্থ বোধ ও রসগ্রহ সম্বন্ধে ব্যাঘাত ঘটিয়া উঠে|” ভবভূতির অসাধারণ দোষ নির্ব্বাচনকালে বিদ্যাসাগর মহাশয় এই কথা বলিয়াছেন। আমরা পূর্ব্বে যাহা উত্তরচরিত হইতে উদ্ধৃত করিয়াছি, তন্মধ্যে এইরূপ দীর্ঘ সমাসের অনেক উদাহরণ পাওয়া যাইবে। এই বিষ্কম্ভকমধ্যে ঐরূপ দীর্ঘ সমাসের বিশেষ আধিক্য। আমরা কয়েকটি উদ্ধৃত করিতেছি, যথা পুষ্পবৃষ্টি;—

“অবিরললুলিতবিকচকনককমলকমনীয়সন্ততিঃ অমরতরুতরুণমণিমুকুলনিকর-মকরন্দসুন্দরঃ পুষ্পনিপাতঃ |”

পুনশ্চ, বাণসৃষ্ট অগ্নি;— “উচ্চণ্ডবজ্রখণ্ডাবস্ফোটপটুতরস্ফুলিঙ্গবিকৃতিঃ উত্তালতুমুললেলিহানজ্বালা- সম্ভারভৈরবো ভগবান্ উষর্ব্বুধঃ |”

পুনশ্চ, বারুণাস্ত্রসৃষ্ট মেঘ;— “অবিরলবিলোলধুণ্ণন্তবিজ্জুল্লদাবিলাসমণ্ডিদেহিং মত্তমোরকঠসামলেহিং জল-হরেহিং |” এবং তৎকালে সৃষ্টির অবস্থা;— “প্রবলবাতাবলিক্ষোভগম্ভীরগুণ্ণায়মানমেঘমেদুরান্ধকারনীরন্ধ্রনিবদ্ধম্ একবার-বিশ্বগ্রসনবিকটবিকরালকালকণ্ঠমুখকন্দরবিবর্ত্তমানমিব যুগান্তযোগনিদ্রানিরুদ্ধসর্ব্ব-দ্বারনারায়ণোদরনিবিষ্টমিব ভূতজাতং প্রবেপতে |”

ঈদৃশ দীর্ঘ সমাস যে রচনা-দোষমধ্যে গণ্য, তাহা আমরা স্বীকার করি। যাহা কিছুতে অর্থবোধের বিঘ্ন হয়, তাহাই দোষ। ঈদৃশ সমাসে অর্থবোধের হানি, সুতরাং ইহা দোষ। নাটকে ইহা বিশেষ যে দোষ, তাহাও স্বীকার করি; কেন না, ইহাতে নাটকের অভিনয়োপযোগিতার হানি হয়। তথাপি এই সমাসগুলি কবিত্বপূর্ণ, ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে।

১ পাতালাভ্যন্তরবর্ত্তী কুঞ্জমধ্যে রাশীকৃত অন্ধকারের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ এবং উত্তপ্ত, প্রদীপ্ত পিত্তলের পিঙ্গলবৎ জ্যোতির্বিশিষ্ট জৃম্ভকাস্ত্রগুলির দ্বারা আকাশমণ্ডল ব্রহ্মাণ্ডপ্রলয়কালীন দুর্নিবার ভৈরব বায়ুর দ্বারা বিক্ষিপ্ত এবং মেঘমিলিত বিদ্যুৎকর্ত্তৃক পিঙ্গলবর্ণ এবং গুহাযুক্ত বিন্ধ্যাদ্রিশিখরব্যাপ্তবৎ দেখাইতেছে।