বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড - উত্তরচরিত
“দিঠ্ঠিআ অপরিহীনরাঅধম্মো ক্খু সো রাআ”—সৌভাগ্যক্রমে সে রাজার রাজধর্ম্ম পালনে ত্রুটি হইতেছে না |”
যে কোন ভাষায় যে কোন নাটকে যাহা কিছু আছে, এতদংশ সৌন্দর্য্যে তাহার তুল্য, সন্দেহ নাই। “দিঠ্ঠিআ অপরিহীনরাঅধম্মো ক্খু সো রাআ|” এইরূপ বাক্য কেবল সেক্ষপীয়রেই পাওয়া যায়। রাম আসিয়াছেন শুনিয়া সীতা আহ্লাদের কথা কিছুই বলিলেন না, কেবল বললেন, “সৌভাগ্যক্রমে সে রাজার রাজধর্ম্মপালনে ত্রুটি হইতেছে না |” কিন্তু দূর হইতে রামের সেই বিরহক্লিষ্ট প্রভাতচন্দ্রমণ্ডলবৎ আকার দেখিয়া “সখি, আমায় ধর” বলিয়া তমসাকে ধরিয়া বসিয়া পড়িলেন। এ দিকে রাম পঞ্চবটী দেখিতে দেখিতে, সীতাবিরহপ্রদীপ্তনলে পুড়িতে পুড়িতে, “সীতে! সীতে!” বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। দেখিয়া সীতাও উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিয়া তমসার পদপ্রান্তে পতিত হইয়া ডাকিলেন, “ভগবতি তমসে! রক্ষা কর! রক্ষা কর! আমার স্বামীকে বাঁচাও!”
তমসা বলিলেন, “তুমিই বাঁচাও। তোমার স্পর্শে উনি বাঁচিতে পারেন!” শুনিয়া সীতা বলিলেন, “যা হউক তা হউক, আমি তাহাই করিব!” এই বলিয়া সীতা রামকে স্পর্শ করিলেন।১ রাম চেতনা প্রাপ্ত হইলেন।
পরে সীতার পূর্ব্বকালের প্রিয়সখী, বনদেবতা বাসন্তী সীতার পুত্রীকৃত করিশাবকের সহায়ান্বেষণ করিতে করিতে সেইখানে উপস্থিতা হইলেন। রামের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হওয়ায়, রাম করিশিশুর রক্ষার্থ গেলেন। সে হস্তিশিশু স্বয়ং শত্রুজয় করিয়া করিণীর সহিত ক্রীড়া করিতে লাগিল। তদ্বর্ণনা অতি মধুর।
যেনোদ্গচ্ছদ্বিসকিশলয়স্নিগ্ধদন্তাঙ্কুরেণ
ব্যাকৃষ্টস্তে সুতনু লবলীপল্লবঃ কর্ণপূরাৎ।
সোহয়ং পুত্রস্তব মদমুচাং বারণনাং বিজেতা
যৎকল্যাণং বয়সি তরুণ্যে ভাজনং তস্য জাতঃ ||
ব্যাকৃষ্টস্তে সুতনু লবলীপল্লবঃ কর্ণপূরাৎ।
সোহয়ং পুত্রস্তব মদমুচাং বারণনাং বিজেতা
যৎকল্যাণং বয়সি তরুণ্যে ভাজনং তস্য জাতঃ ||
সখি বাসন্তি, পশ্য পশ্য, কান্তানুবৃত্তিচাতুর্য্যমপি অনুশিক্ষিতং বৎসেন।
লীলোৎখাতমৃণালকাণ্ডকবলচ্ছেদেষু সম্পাতিতাঃ
পুষ্পৎপুষ্করবাসিতস্য পয়সো গণ্ডূষসংক্রান্তয়ঃ।
সেকঃ শীকরিণা করেণ বিহিতঃ কামং বিরামে পুন-
র্যৎস্নেহাদনরালনালনলিনীপত্রাতপত্রং ধৃতম্ || ২
পুষ্পৎপুষ্করবাসিতস্য পয়সো গণ্ডূষসংক্রান্তয়ঃ।
সেকঃ শীকরিণা করেণ বিহিতঃ কামং বিরামে পুন-
র্যৎস্নেহাদনরালনালনলিনীপত্রাতপত্রং ধৃতম্ || ২
১ “যা হউক তা হউক |” এই কথার কত অর্থগাম্ভীর্য্য! বিদ্যাসাগর মহাশয় এই বাক্যের টীকায় লিখিয়াছেন যে, “আমার পাণিস্পর্শে আর্য্যপুত্র বাঁচিবেন কি না, জানি না, কিন্তু ভগবতী বলিতেছেন বলিয়া আমি স্পর্শ করিব |” ইহাতে এই বুঝিতে হইতেছে যে, পাণিস্পর্শ সফল হইবে কি না, এই সন্দেহেই সীতা বলিলেন,“যা হউক তা হউক!” কিন্তু আমাদিগের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বোধ যে সন্দেহে সীতা বলেন নাই যে, “যা হবার হউক!” সীতা ভাবিয়াছিলেন, “রামকে স্পর্শ করিবার আমার কি অধিকার? রাম আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন, তিনি আমাকে বিনাপরাধে বিসর্জ্জন করিয়াছেন,- বিসর্জ্জন করিবার সময়ে একবার আমাকে ডাকিয়াও বলেন নাই যে, আমি তোমাকে ত্যাগ করিলাম—আজি বার বৎসর আমাকে ত্যাগ করিয়া সম্বন্ধ রহিত করিয়াছেন, আজি আবার তাঁহার প্রিয়পত্নীর মত তাঁহার গাত্রস্পর্শ করিব কোন্ সাহসে? কিন্তু তিনি ত মৃতপ্রায়! যা হউক তা হউক, আমি তাঁহাকে স্পর্শ করিব |” তাই ভাবিয়া সীতাস্পর্শে রাম চেতনাপ্রাপ্ত হইলে, সীতা বলিলেন, “ভঅবদি তমসে! ওসরহ্ম, জই দাব মৎ পেক্খিস্মদি তদো তণব্ভণুণ্ণাদসণ্ণিধাণেণ অহিঅদরং মম মহারাও কুবিস্মদি |” তবু “মম মহারাও!”
২ যে নবোদ্গত মৃণালপল্লবের ন্যায় কোমল দন্ত দ্বারা তোমার কর্ণদেশ হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লবলীপল্লব টানিয়া লইত, সেই তোমার পুত্র মদমত্ত বারণগণকে জয় করিল, সুতরাং এখনই সে যুবাবয়সের কল্যাণভাজন হইয়াছে। * * সতি বাসন্তি, দেখ, বাছা কেমন নিজ কান্তার মনোরঞ্জননৈপুণ্যও শিখিয়াছে। খেলা করিতে করিতে মৃণালকাণ্ড উৎপাটিত করিয়া তাহার গ্রাসের অংশে সুগন্ধি পদ্মসুবাসিত জলের গণ্ডূষ মিশাইয়া দিতেছে; এবং শুণ্ডের দ্বারা পর্য্যাপ্ত জলকণায় তাহাকে সিদ্ধ করিয়া, স্নেহে অবক্রদণ্ড নলিনীপত্রের আতপত্র ধরিতেছে।