রজনী
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমি। আর নলচালা?
স। তোমরা লৌহের তারে পৃথিবীময় লিপি চালাইতে পার, আমরা কি নলটি চালাইতে পারি না? তোমাদের একটি ভ্রম আছে, তোমরা মনে কর যে, যাহা ইংরেজেরা জানে, তাহাই সত্য, যাহা ইংরেজ জানে না, তাহা অসত্য, তাহা মনুষ্যজ্ঞানের অতীত, তাহা অসাধ্য। বস্তুত: তাহা নহে। জ্ঞান অনন্ত। কিছু তুমি জান, কিছু আমি জানি, কিছু অন্যে জানে, কিন্তু কেহই বলিতে পারি না যে, আমি সব জানি-আর কেহ আমার জ্ঞানের অতিরিক্ত কিছু জানে না। কিছু ইংরেজে জানে, কিছু আমাদের পূর্বপুরুষেরা জানিতেন। ইংরেজেরা যাহা জানে, ঋষিরা তাহা জানিতেন না ; ঋষিরা যাহা জানিতেন, ইংরেজেরা এ পর্যন্ত তাহা জানিতে পারে নাই। সেই সকল আর্যবিদ্যা প্রায় লুপ্ত হইয়াছে ; আমরা কেহ কেহ দুই একটি বিদ্যা জানি। যত্নে গোপন রাখি-কাহাকেও শিখাই না।
আমি হাসিলাম। সন্ন্যাসী বলিলেন, “তুমি বিশ্বাস করিতেছ না? কিছু প্রত্যক্ষ দেখিতে চাও?”
আমি বলিলাম, “দেখিলে বুঝিতে পারি |”
সন্ন্যাসী বলিল, “পশ্চাৎ দেখাইব। এক্ষণে তোমার সঙ্গে আমার একটি বিশেষ কথা আছে। আমার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা দেখিয়া, তোমার পিতা আমাকে অনুরোধ করিয়াছেন যে, তোমাকে বিবাহে প্রবৃত্তি দিই |”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “প্রবৃত্তি দিতে হইবে না, আমি বিবাহে প্রস্তুত-কিন্তু___”
স। কিন্তু কি?
আমি। কন্যা কই? এক কাণা কন্যা আছে, তাহাকে বিবাহ করিব না।
স। এ বাঙ্গালাদেশে কি তোমার যোগ্যা কন্যা নাই?
আমি। হাজার হাজার আছে, কিন্তু বাছিয়া লইব কি প্রকারে? এই শত সহস্র কন্যার মধ্যে কে আমাকে চিরকাল ভালবাসিবে, তাহা কি প্রকারে বুঝিব?
স। আমার একটি বিদ্যা আছে। যদি পৃথিবীতে এমত কেহ থাকে যে, তোমাকে মর্মান্তিক ভালবাসে, তবে তাহাকে স্বপ্নে দেখাইতে পারি। কিন্তু যে তোমাকে এখন ভালবাসে না, ভবিষ্যতে বাসিতে পারে, তাহা আমার বিদ্যার অতীত।
আমি। এ বিদ্যা বড় আবশ্যক বিদ্যা নহে। যে যাহাকে ভালবাসে, সে তাহাকে প্রায় প্রণয়শালী বলিয়া জানে।
স। কে বলিল? অজ্ঞাত প্রণয়ই পৃথিবীতে অধিক। তোমাকে কেহ ভালবাসে? তুমি কি তাহাকে জান?
আমি। আত্মীয়স্বজন ভিন্ন কেহ যে আমাকে বিশেষ ভালবাসে, এমত জানি না।
স। তুমি আমাদের বিদ্যা কিছু প্রত্যক্ষ করিতে চাহিতেছিলে, আজ এইটি প্রত্যক্ষ কর।
আমি। ক্ষতি কি?
স। তবে শয়নকালে আমাকে শয্যাগৃহে ডাকিও।
আমার শয্যাগৃহ বহির্বাটীতে। আমি শয়নকালে সন্ন্যাসীকে ডাকাইলাম। সন্ন্যাসী আসিয়া আমাকে শয়ন করিতে বলিলেন। আমি শয়ন করিলে, তিনি বলিলেন, “যতক্ষণ আমি এখানে থাকিব, চক্ষু চাহিও না। আমি গেলে যদি জাগ্রত থাক, চাহিও |” সুতরাং আমি চক্ষু মুদিয়া রহিলাম-সন্ন্যাসী কি কৌশল করিল, কিছুই জানিতে পারিলাম না। সন্ন্যাসী যাইবার পূর্বেই আমি নিদ্রাভিভূত হইলাম।
সন্ন্যাসী বলিয়াছিল, পৃথিবীমধ্যে যে নায়িকা আমাকে মর্মান্তিক ভালবাসে, অদ্য তাহাকেই আমি স্বপ্নে দেখিব। স্বপ্ন দেখিলাম বটে। কলকল গঙ্গাপ্রবাহমধ্যে সৈকতভূমি ; তাহার প্রান্তভাগে অর্ধজলমগ্না-কে?
রজনী
* * *
পরদিন প্রভাতে সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাহাকে স্বপ্নে দেখিয়াছিলে?”
আমি। কাণা ফুলওয়ালী।
স। কাণা?
আমি। জন্মান্ধ।
স। আশ্চর্য! কিন্তু যেই হউক, তাহার অধিক পৃথিবীতে আর কেহ তোমাকে ভালবাসে না।
আমি নীরব হইয়া রহিলাম।