মৃণালিনী
ক্ষণে ক্ষণে গৃহের নূতন নূতন খণ্ডসকল অগ্নিকর্তৃক আক্রান্ত হইতেছিল। আক্রান্ত প্রকোষ্ঠ বিষম শিখা আকাশপথে উত্থাপিত করিয়া ভয়ঙ্কর গর্জন করিতেছিল। ক্ষণে ক্ষণে তাঁহার দগ্ধ গৃহাংশসকল অশনিসম্পাতশব্দে ভূতলে পড়িয়া যাইতেছিল। ধূমে, ধূলিতে, তৎসঙ্গে লক্ষ লক্ষ অগ্নিস্ফুলিঙ্গে আকাশ অদৃশ্য হইতে লাগিল।
দাবানল সংবেষ্টিত আরণ্য গজের ন্যায় পশুপতি অগ্নিমধ্যে ইতস্তত: দাসদাসী স্বজন ও মনোরমার অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। কাহারও কোন চিহ্ন পাইলেন না-হতাশ হইলেন। তখন দেবীর মন্দির প্রতি তাঁহার দৃষ্টিপাত হইল। দেখিলেন, দেবী অষ্টভুজার মন্দির অগ্নিকর্তৃক আক্রান্ত হইয়া জ্বলিতেছে। পশুপতি পতঙ্গবৎ তন্মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, অনলমণ্ডলমধ্যে অদগ্ধা স্বর্ণপ্রতিমা বিরাজ করিতেছে। পশুপতি উন্মত্তের ন্যায় কহিলেন, “মা! জগদম্বে! আর তোমাকে জগদম্বা বলিব না। আর তোমায় পূজা করিব না। তোমাকে প্রণামও করিব না। আশৈশব আমি কায়মনোবাক্যে তোমার সেবা করিলাম-ঐ পদধ্যান ইহজন্মে সার করিয়াছিলাম-এখন, মা, এক দিনের পাপে সর্বস্ব হারাইলাম। তবে কি জন্য তোমার পূজা করিয়াছিলাম? কেনই বা তুমি আমার পাপমতি অপনীত না করিলে?”
মন্দিরদহন অগ্নি অধিকতর প্রবল হইয়া গর্জিয়া উঠিল। পশুপতি তথাপি প্রতিমা সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ঐ দেখ! ধাতুমূর্তি!-তুমি ধাতুমূর্তি মাত্র, দেবী নহ-ঐ দেখ অগ্নি গর্জিতেছে! যে পথে আমার প্রাণাধিকা গিয়াছে-সেই পথে অগ্নি তোমাকেও প্রেরণ করিবে। কিন্তু আমি অগ্নিকে এ কীর্তি রাখিতে দিব না-আমি তোমাকে স্থাপনা করিয়াছিলাম-আমিই তোমাকে বিসর্জন করিব। চল! ইষ্টদেবি! তোমাকে গঙ্গা জলে বিসর্জন করিব |”
এই বলিয়া পশুপতি প্রতিমা উত্তোলন আকাঙ্ক্ষায় উভয় হস্তে তাহা ধারণ করিলেন। সেই সময়ে আবার অগ্নি গর্জিয়া উঠিল। তখনই পর্বতবিদানুরূপ প্রবল শব্দ হইল,-দগ্ধ মন্দির, আকাশপথে ধূলিধূমভস্ম সহিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গরাশি প্রেরণ করিয়া, চূর্ণ হইয়া পড়িয়া গেল। তন্মধ্যে প্রতিমা সহিত পশুপতি সজীবন সমাধি হইল।