মৃণালিনী
ম। রাজা হইয়া যদি তাহা কর, রাজ্য অপেক্ষা মহিষী যদি অধিক ভালবাস, তবে তুমি রাজ্য করিতে পারিবে না। তুমি রাজ্যচ্যুত হইবে। স্ত্রৈণ-রাজার রাজ্য থাকে না।
পশুপতি প্রশংসমান লোচনে মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন; কহিলেন, “যাহার বামে এমন সরস্বতী, তাহার আশঙ্কা কি? না হয়, তাহাই হউক। তোমার জন্য রাজ্য ত্যাগ করিব |”
ম। তবে রাজ্য গ্রহণ করিতেছ কেন? ত্যাগের জন্য গ্রহণে ফল কি?
প। তোমার পাণিগ্রহণ।
ম। সে আশা ত্যাগ কর। তুমি রাজ্যলাভ করিলে আমি কখনও তোমার পত্নী হইব না।
প। কেন, মনোরমা! আমি কি অপরাধ করিলাম?
ম। তুমি বিশ্বাসঘাতক-আমি বিশ্বাসঘাতককে কি প্রকারে ভক্তি করিব? কি প্রকারে বিশ্বাসঘাতককে ভালবাসিব?
প। কেন, আমি কিসে বিশ্বাসঘাতক হইলাম?
ম। তোমার প্রতিপালক প্রভুকে রাজ্যচ্যুত করিবার কল্পনা করিতেছ; শরণাগত রাজপুত্রকে মারিবার কল্পনা করিতেছ; ইহা কি বিশ্বাসঘাতকের কর্ম নয়? যে প্রভুর বিশ্বাস নষ্ট করিল, সে স্ত্রীর নিকট অবিশ্বাসী না হইবে কেন?
পশুপতি নীরব হইয়া রহিলেন। মনোরমা পুনরপি বলিতে লাগিলেন, “পশুপতি, আমি মিনতি করিতেছি, এই দুর্বুদ্ধি ত্যাগ কর |”
পশুপতি পূর্ববৎ অধোবদনে রহিলেন। তাঁহার রাজ্যাকাঙ্ক্ষা এবং মনোরমাকে লাভ করিবার আকাঙ্ক্ষা উভয়ই গুরুতর। কিন্তু রাজ্যলাভের যত্ন করিলে মনোরমার প্রণয় হারাইতে হয়। সেও অত্যাজ্য। উভয় সঙ্কটে তাঁহার চিত্তমধ্যে গুরুতর চাঞ্চল্য জন্মিল। তাঁহার মতির স্থিরতা দূর হইতে লাগিল। “যদি মনোরমাকে পাই, ভিক্ষাও ভাল, রাজ্যে কাজ কি?” এইরূপ পুন: পুন: মনে ইচ্ছা হইতে লাগিল। কিন্তু তখনই আবার ভাবিতে লাগিলেন, “কিন্তু তাহা হইলে লোকনিন্দা, জনসমাজে কলঙ্ক, জাতিনাশ হইবে; সকলের ঘৃণিত হইব। তাহা কি প্রকারে সহিব?” পশুপতি নীরব রহিলেন; কোন উত্তর করিতে পারিলেন না।
মনোরমা উত্তর না পাইয়া কহিতে লাগিল, “শুন পশুপতি, তুমি আমার কথায় উত্তর দিলে না। আমি চলিলাম। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে ইহজন্মে আমার সাক্ষাৎ হইবে না |”
এই বলিয়া মনোরমা পশ্চাৎ ফিরিল। পশুপতি রোদন করিয়া উঠিলেন।
অমনই মনোরমা আবার ফিরিল। আসিয়া, পশুপতির হস্তধারণ করিল। পশুপতি তাঁহার মুখপানে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, তেজোগর্ববিশিষ্টা, কুঞ্চিতভ্রূবীচিবিক্ষেপকারিণী সরস্বতী মূর্তি আর নাই; সে প্রতিভা দেবী অন্তর্ধান হইয়াছেন; কুসুমসুকুমারী বালিকা তাঁহার হস্তধারণ করিয়া তাঁহার সঙ্গে রোদন করিতেছে।
মনোরমা কহিলেন, “পশুপতি, কাঁদিতেছ কেন?”
পশুপতি চক্ষুর জল মুছিয়া কহিলেন, “তোমার কথায় |”
ম। কেন, আমি কি বলিয়াছি?
প। তুমি আমাকে ত্যাগ করিয়া যাইতেছিলে।
ম। আর আমি এমন করিব না।
প। তুমি আমার রাজমহিষী হইবে?
ম। হইব।
পশুপতির আনন্দসাগর উছলিয়া উঠিল। উভয়ে অশ্রুপূর্ণ লোচনে উভয়ের মুখপ্রতি চাহিয়া উপবেশন করিয়া রহিলেন। সহসা মনোরমা পক্ষিণীর ন্যায় গাত্রোত্থান করিয়া চলিয়া গেলেন।