মৃণালিনী
হে। পশ্চাৎ বলিব; এ রাত্রে এখানে কেন?
ম। তোমার এ বেশ কেন? হাতে শূল; কাঁকালে তরবারি; তরবারে এ কি জ্বলিতেছে? এ কি হীরা? মাথায় এ কি? ইহাতে ঝকমক করিয়া জ্বলিতেছে, এই বা কি? এও কি হীরা? এত হীরা পেলে কোথা?
হে। আমার ছিল।
ম। এ রাত্রে এত হীরা পরিয়া কোথায় যাইতেছ? চোরে যে কাড়িয়া লইবে?
হে। আমার নিকট হইতে চোরে কাড়িতে পারে না।
ম। তা এত রাত্রে এত অলঙ্কারে প্রয়োজন কি? তুমি কি বিবাহ করিতে যাইতেছ?
হে। তোমার কি বোধ হয়, মনোরমা?
ম। মানুষ মারিবার অস্ত্র লইয়া কেহ বিবাহ করিতে যায় না। তুমি যুদ্ধে যাইতেছ।
হে। কাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিব? তুমিই বা এখানে কি করিতেছিলে?
ম। স্নান করিতেছিলাম। স্নান করিয়া বাতাসে চুল শুকাইতেছিলাম। এই দেখ, চুল এখনও ভিজা রহিয়াছে।
এই বলিয়া মনোরমা আর্দ্র কেশ হেমচন্দ্রের হস্তে স্পর্শ করাইলেন।
হে। রাত্রে স্নান কেন?
ম। আমার গা জ্বালা করে।
হে। গঙ্গাস্নান না করিয়া এখানে কেন?
ম। এখানকার জল বড় শীতল।
হে। তুমি সর্বদা এখানে আইস?
ম। আসি।
হে। আমি তোমার সম্বন্ধ করিতেছি-তোমার বিবাহ হইবে। বিবাহ হইলে এরূপ কি প্রকারে আসিবে?
ম। আগে বিবাহ হউক।
হেমচন্দ্র হাসিয়া কহিলেন, “তোমার লজ্জা নাই-তুমি কালামুখী |”
ম। তিরস্কার কর কেন? তুমি যে বলিয়াছিলে, তিরস্কার করিবে না।
হে। সে অপরাধ লইও না। এখান দিয়া কাহাকেও যাইতে দেখিয়াছ?
ম। দেখিয়াছি।
হে। তাহার কি বেশ?
ম। তুরকের বেশ।
হেমচন্দ্র অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “সে কি? তুমি তুরক চিনিলে কি প্রকারে?”
ম। আমি পূর্বে তুরক দেখিয়াছি।
হে। সে কি? কোথায় দেখিলে?
ম। যেখানে দেখি না-তুমি কি সেই তুরকের অনুসরণ করিবে?
হে। করিব-সে কোন্ পথে গেল?
ম। কেন?
হে। তাহাকে বধ করিব।
ম। মানুষ মেরে কি হবে?
হে। তুরক আমার পরম শত্রু।
ম। তবে একটি মারিয়া কি তৃপ্তি লাভ করিবে?
হে। আমি যত তুরক দেখিতে পাইব, তত মারিব।
ম। পারিবে?
হে। পারিব।
মনোরমা বলিল, “তবে সাবধানে আমার সঙ্গে আইস |”
হেমচন্দ্র ইতস্তত: করিতে লাগিলেন। যবনযুদ্ধে এই বালিকা পথপ্রদর্শিনী!
মনোরমা তাঁহার মানসিক ভাব বুঝিলেন; বলিলেন, “আমাকে বালিকা ভাবিয়া অবিশ্বাস করিতেছ?”
হেমচন্দ্র মনোরমার প্রতি চাহিয়া দেখিলেন। বিস্ময়াপন্ন হইয়া ভাবিলেন-মনোরমা কি মানুষী?